3. পানাহারের আদব-কায়দা

【1】

শুরুতে বিস্মিল্লাহ এবং শেষে আল-হামদু লিল্লাহ বলা

উমার ইবনে আবূ সালামাহ (রাঃ) তিনি বলেন, (একদা খাবার সময়) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘‘(শুরুতে) ‘বিসমিল্লাহ’ বল, ডান হাত দ্বারা আহার কর এবং তোমার নিকট (সামনে) থেকে খাও।’’ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের কেউ যখন আহার করবে, সে যেন শুরুতে আল্লাহ তা‘আলার নাম নেয়। যদি শুরুতে আল্লাহর নাম নিতে ভুলে যায়, তাহলে সে যেন বলে ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু অ আখেরাহ।’’ জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘‘কোন ব্যক্তি যখন নিজ বাড়ি প্রবেশের সময় ও আহারের সময় আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে; অর্থাৎ (‘বিসমিল্লাহ’ বলে) তখন শয়তান তার অনুচরদেরকে বলে, ‘আজ না তোমরা এ ঘরে রাত্রি যাপন করতে পারবে, আর না খাবার পাবে।’ অন্যথা যখন সে প্রবেশ কালে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে না (অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহ’ বলে না), তখন শয়তান বলে, ‘তোমরা রাত্রি যাপন করার স্থান পেলে।’ আর যখন আহার কালেও আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে না (অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহ’ বলে না), তখন সে তার চেলাদেরকে বলে, ‘তোমরা রাত্রিযাপন স্থল ও নৈশভোজ উভয়ই পেয়ে গেলে।’’ হুযাইফাহ (রাঃ) আমরা যখন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে আহারে বসতাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারে হাত রেখে শুরু না করা পর্যন্ত আমরা তাতে হাত রাখতাম না (এবং আহার শুরু করতাম না)। একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে খাবারে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ একটি বাচ্চা মেয়ে এমনভাবে এল, যেন তাকে (পিছন থেকে) ধাক্কা দেওয়া হচ্ছিল এবং সে নিজ হাত খাবারে দিতে উদ্যত হয়েছিল, এমন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত ধরে নিলেন। তারপর এক বেদুঈনও (তদ্রূপ দ্রুত বেগে) এল, যেন তাকে ধাক্কা মারা হচ্ছিল (সেও খাবারে হাত রাখতে উদ্যত হলে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতও ধরে নিলেন এবং বললেন, ‘‘যে খাবারে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, শয়তান সে খাদ্যকে হালাল মনে করে। আর এ মেয়েটিকে শয়তানই নিয়ে এসেছে, যাতে ওর বদৌলতে নিজের জন্য খাদ্য হালাল করতে পারে। কিন্তু আমি তার হাত ধরে ফেললাম। তারপর সে বেদুঈনকে নিয়ে এল, যাতে ওর দ্বারা খাদ্য হালাল করতে পারে। কিন্তু আমি ওর হাতও ধরে নিলাম। সেই মহান সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ আছে, শয়তানের হাত ঐ দু’জনের হাতের সঙ্গে আমার হাতে (ধরা পড়েছিল)।’’ অতঃপর তিনি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আহার করলেন। উমাইয়্যাহ্ ইবনু মাখ্শী সাহাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা ছিলেন এবং এক ব্যক্তি আল্লাহর নাম না নিয়েই খাবার খাচ্ছিলো। তার খাওয়া শেষ হতে আর কেবল এক লোকমা বাকি। এই শেষ লোকমাটি মুখে দেওয়ার সময় সে বললো, ‘‘বিস্মিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু’’ (আমি আল্লাহর নাম নিচ্ছি খাওয়ার শুরু এবং শেষভাগে)। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন। তিনি বললেনঃ তার সাথে শাইতান বরাবর খাবার খেয়ে যাচ্ছিল। সে আল্লাহর নাম নেয়ার সাথে সাথেই শাইতানের পেটে যা কিছু ছিল, বমি করে সবকিছু ফেলে দিল। (আবু দাউদ, নাসায়ী) আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ছয়জন সাহাবীর সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য আহার করছিলেন। এমন সময় এক বেদুঈন হাযির হল এবং সে দু’গ্রাসেই সমস্ত খাদ্য খেয়ে ফেলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এ সব দেখে) বললেন, ‘‘শোনো! যদি এ ব্যক্তি (শুরুতে) ‘বিসমিল্লাহ’ বলত, তাহলে এই খাবারই তোমাদের সবার জন্য যথেষ্ট হত।’’ আবূ উমামাহ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দস্তরখানা গুটাতেন, তখন এই দো‘আ পড়তেনঃ- “আলহামদু লিল্লা-হি হামদান কাসীরান ত্বাইয়্যিবাম মুবা-রাকান ফীহি গায়রা মাকফিইয়্যিন অলা মুওয়াদ্দাইন অলা মুস্তাগনান আনহু রাব্বানা।” অর্থাৎ আল্লাহর জন্য অগণিত পবিত্র ও বরকতপূর্ণ প্রশংসা। অকুণ্ঠ, নিরবচ্ছিন্ন, প্রয়োজন-সাপেক্ষ প্রশংসা। হে আমাদের প্রভু! মু‘আয ইবনে আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আহার শেষে এই দো‘আ পড়বেঃ- ‘আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত্ব্আমানী হা-যা অরাযাক্বানীহি মিন গাইরি হাওলিম মিন্নী অলা ক্বুউওয়াহ।’ (অর্থাৎ সেই আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমাকে এ খাওয়ালেন এবং জীবিকা দান করলেন, আমার কোন চেষ্টা ও সামর্থ্য ছাড়াই) সে ব্যক্তির পূর্বের সমস্ত (ছোট) পাপ মোচন করে দেওয়া হবে।’’

【2】

কোন খাবারের দোষত্রুটি বর্ণনা না করা এবং তার প্রশংসা করা উত্তম

আবূ হুরাইরা (রাঃ) নি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোন খাবারের দোষ বর্ণনা করেননি। ভাল লাগলে তিনি তা খেয়েছেন এবং খারাপ লাগলে তিনি তা ত্যাগ করেছেন।’ জাবের (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পরিবারের কাছে তরকারি চাইলেন। তারা বলল, ‘আমাদের নিকট সির্কা ছাড়া আর কিছুই নেই।’ তিনি তাই চাইলেন এবং (তা দিয়ে) আহার করতে থাকলেন ও বলতে থাকলেন, ‘‘সির্কা কতই না চমৎকার তরকারি। সির্কা কতই না ভাল ব্যঞ্জন।’’

【3】

নফল রোযাদারের সামনে খাবার এসে গেলে যখন সে রোযা ভাঙ্গতে প্রস্তুত নয়, তখন সে কী বলবে?

আবূ হুরাইরা (রাঃ) , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখন তোমাদের কাউকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া হয়, তখন সে যেন তা (কোন আপত্তিকর ব্যাপার না থাকলে সাদরে) গ্রহণ করে। আর সে যদি রোযা অবস্থায় থাকে, তাহলে (দাওয়াতকারীর জন্য) দো‘আ করে। আর যদি রোযা অবস্থায় না থাকে, তাহলে যেন আহার করে .

【4】

নিমন্ত্রিত ব্যক্তির কেউ সাথী হলে সে নিমন্ত্রণদাতাকে কী বলবে?

আবূ মাস‘ঊদ বদরী (রাঃ) তিনি বলেন, একটি লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খাবারের জন্য দাওয়াত দিল, যা সে পাঁচ জনের জন্য প্রস্তুত করেছিল, যার পঞ্চম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। (রাস্তায়) এক (অনাহূত) ব্যক্তি তাঁদের অনুগামী হল। যখন তাঁরা বাড়ির দরজায় পৌঁছলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আমন্ত্রণকারীকে) বললেন, ‘‘এ ব্যক্তি আমাদের সাথে চলে এসেছে। তুমি চাইলে ওকে অনুমতি দিতে পার, না চাইলে ও ফিরে যাবে।’’ কিন্তু সে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! বরং আমি তাকে অনুমতি দিলাম।’

【5】

নিজের সামনে এক ধার থেকে আহার করা ও বে-নিয়ম আহারকারীকে উপদেশ ও আদব-কায়দা শিক্ষা দেওয়া প্রসঙ্গে

উমার ইবনে আবী সালামাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আমি বাল্যকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তত্ত্বাবধানে ছিলাম। একদা খাবার পাত্রে আমার হাত ছুটাছুটি করছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘‘ওহে কিশোর! ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ডান হাতে খাও এবং তোমার সামনে এক তরফ থেকে খাও।’’ সালামা ইবনে আকওয়া (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে একটি লোক তার বাম হাত দ্বারা আহার করল। (এ দেখে) তিনি বললেন, ‘‘তুমি ডান হাত দ্বারা খাও।’’ সে বলল, ‘আমি পারবো না!’ তিনি বদ-দো‘আ দিয়ে বললেন, ‘‘তুমি যেন না পারো।’’ ওর অহংকারই ওকে (কথা মানতে) বাধা দিয়েছিল। সুতরাং তারপর থেকে সে আর তার হাত মুখে তুলতে পারেনি।

【6】

একপাত্রে দলবদ্ধভাবে খাবার সময় সাথীদের অনুমতি ছাড়া খেজুর বা অনুরূপ কোন ফল জোড়া জোড়া খাওয়া নিষেধ।

জাবালাহ ইবনে সুহাইম ইবনে যুবাইরের খেলাফতকালে আমরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছিলাম। সুতরাং আমাদেরকে খেজুর দেওয়া হত। আর ‘আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেন, যখন আমরা তা আহার করতাম। তিনি বলতেন, ‘তোমরা জোড়া জোড়া খেজুর এক সাথে খাবে না। কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোড়া খেজুর (দুটো খেজুর এক সঙ্গে) খেতে বারণ করেছেন।’ তারপর বললেন, ‘তবে যদি তার সঙ্গী ভাইয়ের কাছে সে অনুমতি গ্রহণ করে (তবে তা স্বতন্ত্র ব্যাপার)।’

【7】

খাওয়া সত্ত্বেও পরিতৃপ্ত না হলে কী বলা ও করা উচিত?

অহশী ইবনে হার্ব (রাঃ) সাহাবাগণ নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমরা খাই, কিন্তু যেন পেট ভরে না।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে হয়তো তোমরা আলাদা আলাদা খাও।’’ তারা বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘‘তোমরা জামা‘আতবদ্ধভাবে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আহার করো, তাহলে তাতে তোমাদের জন্য বরকত দান করা হবে।’’

【8】

খাবার বাসনের এক ধার থেকে খাওয়ার নির্দেশ এবং তার মাঝখান থেকে খাওয়া নিষেধ

ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যেহেতু খাবারের মাঝখানে বরকত নাযিল হয়, সেহেতু তোমরা ওর দুই ধার থেকে খাও, আর ওর মাঝখান থেকে খেয়ো না।’’ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী হাসান সহীহ) আব্দুল্লাহ ইবনে বুস্‌র (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি পাত্র ছিল যাকে ‘গার্রা’ বলা হত, সেটাকে চারজন মানুষ ধরে তুলতো। একদা চাশ্তের সময়ে যখন চাশ্তের নামায পড়ার পর ঐ (বিশাল) পাত্রটি আনা হল---অর্থাৎ তাতে ‘সারীদ’ (মাংস ও খন্ড খন্ড রুটি সংমিশ্রণে প্রস্তুত সুস্বাদু খাদ্য) রাখার পর, তখন লোকেরা তাতে জমায়েত হল। লোকের পরিমাণ যখন বেশি হল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁটুর ভরে বসে পড়লেন। (এরূপ দেখে) জনৈক বেদুঈন বলল, ‘এ কেমন বসা?’ আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘নিশ্চিতরূপে আল্লাহ আমাকে ভদ্র (বিনয়ী) বান্দা করেছেন এবং উদ্ধত ও হঠকারী করেননি।’’ তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তোমরা পাত্রের এক ধার থেকে খেতে থাক। আর ওর শীর্ষভাগ ছেড়ে দাও, ওখানে বরকত অবতীর্ণ হবে।’’

【9】

ঠেস দিয়ে বসে আহার করা অপছন্দনীয়

আবূ জুহাইফা অহাব ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমি হেলান দিয়ে বসে আহার করি না।’’ আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উঁচু হয়ে বসে খেজুর খেতে দেখেছি।’

【10】

তিন আঙ্গুল দ্বারা খাবার খাওয়া মুস্তাহাব

ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের কেউ যখন আহার করে, সে যেন তার আঙ্গুলগুলি না মুছে; যতক্ষণ না সে তা নিজে চেটে খায় কিংবা অন্য (শিশু প্রভৃতি)কে দিয়ে চাঁটিয়ে নেয়।’’ কা‘ব ইবনে মালেক (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিন আঙ্গুল দ্বারা (রুটি, খেজুর ইত্যাদি) খেতে দেখেছি। অতঃপর যখন তিনি খাবার শেষ করলেন, তখন সেগুলিকে চাটলেন। জাবের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারান্তে আঙ্গুল ও থালা চেটে খাবার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘‘তোমরা জান না যে, তোমাদের কোন্ খাদ্যে বরকত নিহিত আছে।’’ উক্ত রাবী ‘‘যখন কারো খাদ্য গ্রাস (বা দানা পাত্রের বাইরে) পড়ে যাবে, তখন সে যেন তা থেকে নোংরা দূর করে খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা ছেড়ে না দেয়। আর রুমালে হাত মুছে ফেলার পূর্বে যেন আঙ্গুলগুলি চেটে নেয়। কেননা, সে জানে না যে, তার কোন্ খাদ্যাংশে বরকত নিহিত আছে।’’ উক্ত রাবী , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘শয়তান তোমাদের সমস্ত কাজ কর্মে তোমাদের নিকট উপস্থিত হয়; এমনকি তোমাদের খাবারের সময়েও উপস্থিত হয়। সুতরাং যখন কারো খাবার লুকমা (থালার বাইরে) পড়ে যায়, তখন সে যেন তা তুলে তা থেকে নোংরা পরিষ্কার করে খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা ফেলে না রাখে। আর আহারান্তে আঙ্গুলগুলি চেটে নেয়। কারণ, তার জানা নেই যে, তার কোন্ খাবারে বরকত নিহিত আছে। আনাস (রাঃ) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আহার করতেন তখন নিজ তিনটি আঙ্গুল চেটে খেতেন এবং বলতেন, ‘‘কারো খাবারের লুকমা নিচে পড়ে গেলে, সে যেন তা তুলে পরিষ্কার করে খেয়ে ফেলে এবং শয়তানের জন্য ফেলে না রাখে।’’ আর তিনি আমাদেরকে খাদ্যপাত্র (বা বাসন) চেটে খেতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘‘তোমরা জান না যে, তোমাদের কোন্ খাবারে বরকত নিহিত আছে।’’ ‘ঈদ ইবন হারেস তিনি জাবের (রাঃ)-কে আগুনে স্পর্শ করা বস্তু খাওয়ার পর ওযূ করা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, ‘না। (ওযূ করতে হবে না।) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে তো আমরা এরূপ খাদ্য খুব কমই পেতাম। আর যখন আমরা তা পেতাম, তখন আমাদের তো হাতের চেটো, হাতের নলা ও পা ছাড়া কোন রুমাল ছিল না। (আমরা এগুলিতে মুছে ফেলতাম।) তারপর (নতুন) ওযূ না করেই আমরা নামায আদায় করতাম।

【11】

কোন সীমিত খাবারে অনেক মানুষের হাত পড়লে বরকত হয়

আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘দু’জনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট এবং তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট।’’ জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘‘একজনের খাবার দু’জনের জন্য যথেষ্ট এবং দু’জনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট, আর চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট।’’

【12】

পান করার আদব-কায়দা

আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি পান করার সময় তিনবার দম নিতেন। (অর্থাৎ তিনি পান পাত্রের বাইরে তিনবার নিঃশ্বাস ফেলতেন।) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উঁটের ন্যায় তোমরা এক নিঃশ্বাসে পানি পান করো না, বরং দুই তিনবার (শ্বাস নিয়ে) পান করো। আর যখন তোমরা পানি পান করা শুরু কর তখন বিসমিল্লাহ বলো এবং যখন পান করা শেষ করো তখন ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলো। হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এটি হাসান হাদীস। (আমি (আলবানী) বলছিঃ হাদীসটির সনদ দুর্বল যেমনটি আমি ‘‘তাখরীজুল মিশকাত’’ গ্রন্থে (নং ৪২৭৮) বলেছি। কারণ এর বর্ণনাকারী ইবনু আতা ইবনে আবী রাবাহ্ দুর্বল। তিনি হচ্ছেন ইয়াকূব। আর ইয়াযীদ ইবনু সিনান জাযারী হচ্ছেন আবূ ফারওয়াহ্ আররাহাবী। তার সম্পর্কে নাসাঈ বলেনঃ তিনি মাতরূকুল হাদীস আর ইবনু আদী বলেনঃ তার অধিকাংশ হাদীস নিরাপদ নয়। দেখুন ‘‘সিলসিলাহ্ সহীহাহ্’’ আবূ ক্বাতাদা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলতে নিষেধ করেছেন। আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পানি মিশ্রিত দুধ আনা হল। (তখন) তাঁর ডান দিকে এক বেদুঈন ছিল ও বাম দিকে আবূ বকর (রাঃ) (বসে) ছিলেন। বস্তুত তিনি তা পান করে বেদুঈনকে দিলেন এবং বললেন, ‘‘ডান দিকের ব্যক্তির অগ্রাধিকার রয়েছে, তারপর তার ডান দিকের ব্যক্তির অগ্রাধিকার রয়েছে।’’ সাহল ইবনে সা‘দ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে শরবত পরিবেশন করা হল। তিনি তা থেকে পান করলেন। আর তাঁর ডান দিকে ছিল একটি বালক। আর বাম দিকে ছিল কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালকটিকে বললেন, ‘‘তুমি কি আমাকে অনুমতি দেবে, আমি ঐ বয়স্ক লোকগুলিকে আগে পান করতে দিই?’’ বালকটি বলল, ‘আল্লাহর কসম! আপনার কাছ থেকে আমার ভাগে আসা জিনিসের ক্ষেত্রে আমি কাউকে আমার উপর অগ্রাধিকার দেব না।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন পেয়ালাটি তার হাতে তুলে দিলেন।’

【13】

মশ্ক ইত্যাদির মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান করা অপছন্দনীয়, তবে তা হারাম নয়

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মশকের মুখ বাঁকিয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন। আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মশকের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে বারণ করেছেন। উম্মে সাবেত কাব্‌শাহ বিনতে সাবেত, হাস্‌সান ইবনে সাবেতের ভগিনী (রাঃ) তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট এলেন এবং একটি ঝুলন্ত মশকের মুখ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি পান করলেন। সুতরাং আমি উঠে তার মুখটা কেটে নিলাম। (তিরমিযী হাসান সহীহ)

【14】

পানি পান করার সময় তাতে ফুঁ দেওয়া মাকরূহ

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানীয় পানকালে তাতে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। একটি লোক নিবেদন করল, ‘পানপাত্রে (যদি) আমি খড়কুটো দেখতে পাই?’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তা ঢেলে ফেলে দাও।’’ সে নিবেদন করল, ‘এক শ্বাসে পানি পান করে আমার তৃপ্তি হয় না।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তুমি পেয়ালা মুখ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে নিঃশ্বাস গ্রহণ করো।’’ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানপাত্রে নিঃশ্বাস ফেলতে বা তাতে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন।

【15】

দাঁড়িয়ে পান করা

ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যমযমের পানি পান করিয়েছি। তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করেছেন।’ নায্যাল ইবনে সাবরাহ (রাঃ) তিনি বলেন, কুফা নগরীর ‘রাহবাহ’র দ্বারপ্রান্তে আলী (রাঃ) এসে দাঁড়িয়ে পানি পান করলেন এবং বললেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঠিক এভাবে (পান) করতে দেখেছি, যেভাবে তোমরা আমাকে (পান) করতে দেখলে।’ ইবনে ‘উমার (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে আমরা চলতে চলতে আহার করতাম এবং দাঁড়িয়ে পান করতাম।’ আমর ইবনে শু‘আইব তাঁর পিতা থেকে তিনি স্বীয় দাদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাঁড়িয়ে ও বসে পানি পান করতে দেখেছি।’ আনাস (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোককে দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। কাতাদাহ বলেন, আমরা আনাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম, ‘আর (দাঁড়িয়ে) খাওয়া?’ তিনি বললেন, ‘তা তো আরো মন্দ বা আরো জঘন্য কাজ।’ আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের কেউ যেন অবশ্যই দাঁড়িয়ে পান না করে। আর যদি ভুলে যায় (ভুলবশতঃ পান করে ফেলে), তাহলে সে যেন বমি করে দেয়।’’

【16】

পানীয় পরিবেশনকারীর সবার শেষে পান করা উত্তম

আবূ কাতাদাহ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘লোকদেরকে পানি পরিবেশনকারী তাদের সবার শেষে পান করবে।’’

【17】

পান-পাত্রের বিবরণ

আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘একবার নামাযের সময় উপস্থিত হলে যাঁদের বাড়ি কাছে ছিল, তাঁরা (ওযূ করার জন্য) বাড়ি গেলেন। আর কিছু লোক থেকে গেলেন (তাঁদের কোন ওযূর ব্যবস্থা ছিল না)। সুতরাং আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে একটি পাথরের পাত্রে পানি আনা হল। পাত্রটি এত ছোট ছিল যে, তার মধ্যে তাঁর মুঠি খোলাও মুশকিল ছিল। তা থেকেই সমস্ত লোক ওযূ করলেন।’ (আনাসকে উপস্থিত) লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কতজন ছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘আশিজনেরও বেশি। আব্দুল্লাহ ইবনে যায়দ (রাঃ) তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আমাদের নিকট এলেন। আমরা তাঁকে পিতলের একটি পাত্রে পানি দিলাম, তিনি (তা দিয়ে) ওযূ করলেন।’ জাবের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক আনসারীর নিকট গেলেন। আর তাঁর সঙ্গে একজন সাহাবীও ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘যদি তোমার মশকে রাতের বাসী পানি থাকে, তাহলে নিয়ে এসো; নচেৎ সরাসরি পানিতে মুখ লাগিয়ে পান করে নেব।’’ হুযাইফা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে পাতলা ও মোটা রেশমী কাপড় পরতে ও সোনা-রূপার পাত্রে পান করতে নিষেধ করেছেন। আর তিনি বলেছেন, ‘‘তা হল তাদের (কাফেরদের) জন্য দুনিয়ায় এবং তোমাদের (মুসলিমদের) জন্য পরকালে।’’ উম্মে সালামাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি রূপার পাত্রে পান করে, সে আসলে নিজ উদরে জাহান্নামের আগুন ঢক্‌ঢক্‌ করে পান করে।’’