8. সফরের আদব-কায়দা

【1】

বৃহস্পতিবার সকালে সফরে বের হওয়া উত্তম

কা‘ব ইবনে মালেক (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক অভিযানে বৃহস্পতিবার বের হলেন। আর তিনি বৃহস্পতিবার (সফরে) বের হওয়া পছন্দ করতেন। খর ইবনে অদা‘আহ গামেদী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার উম্মতের জন্য তাদের সকালে বরকত দাও।’’ আর তিনি যখন সেনার ছোট বাহিনী অথবা বড় বাহিনী পাঠাতেন, তখন তাদেরকে সকালে রওয়ানা করতেন। স্বাখর ব্যবসায়ী ছিলেন। সুতরাং তিনি তাঁর ব্যবসার পণ্য সকালেই প্রেরণ করতেন। ফলে তিনি (এর বরকতে) ধনী হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর মাল প্রচুর হয়েছিল। (আবূ দাঊদ, তিরমিযী হাসান)

【2】

সফরের জন্য সাথী খোঁজ করা এবং কোন একজনকে আমীর (দলপতি) নিযুক্ত করে তার আনুগত্য করা শ্রেয়

ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘যদি লোকেরা জানত যে, একাকী সফরে কী ক্ষতি রয়েছে ; যা আমি জানি, তাহলে কোন সওয়ার একাকী সফর করত না ।’’(বুখারী) আম্র ইবনে শুআইব তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা (আব্দুল্লাহ ইবনে আম্র) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘একজন (সফরকারী) আরোহী একটি শয়তান এবং দু’জন আরোহী দু’টি শয়তান । আর তিনজন আরোহী একটি কাফেলা ।’’ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ বিশুদ্ধসূত্রে) আবূ সাঈদ ও আবূ হুরাইরা (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘যখন তিন ব্যক্তি সফরে বের হবে, তখন তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।’’ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘সর্বোত্তম সঙ্গী হল চারজন, সর্বোত্তম ছোট সেনাবাহিনী হল চারশ’ জন, সর্বোত্তম বড় সেনাবাহিনী হল চার হাজার জন । আর বারো হাজার সৈন্য স্বল্পতার কারণে কখনো পরাজিত হবে না ।’’

【3】

সফরে চলা, বিশ্রাম নিতে অবতরণ করা, রাত কাটানো এবং সফরে ঘুমানোর আদব-কায়দা । রাতে পথচলা মুস্তাহাব, সওয়ারী পশুদের প্রতি নম্রতা প্রদর্শন করা এবং তাদের বিশ্রামের খেয়াল রাখা । যে তাদের অধিকারের ব্যাপারে ত্রুটি করে তাকে তাদের অধিকার আদায়ের নির্দেশ দেওয়া । সওয়ারী সমর্থ হলে আরোহীর নিজের পিছনে অন্য কাউকে বসানো বৈধ ।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘যখন তোমরা সবুজ-শ্যামল ঘাসে ভরা যমীনে সফর করবে, তখন উটকে তার যমীনের অংশ দাও (অর্থাৎ কিছুক্ষণ চরতে দাও) । আর যখন তোমরা ঘাস-পানিবিহীন যমীনে সফর করবে, তখন তার উপর চড়ে দ্রুত চলো এবং তার শক্তি শেষ হওয়ার পূর্বেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাও । আর যখন তোমরা রাতে বিশ্রামের জন্য কোন স্থানে অবতরণ করবে, তখন আম রাস্তা থেকে দূরে থাকো । কারণ, তা রাতে (হিংস্র) জন্তুদের রাস্তা এবং (বিষাক্ত) পোকামাকড়ের আশ্রয় স্থল ।’’ আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন সফরে থাকতেন এবং রাতে বিশ্রামের জন্য কোথাও অবতরণ করতেন, তখন তিনি ডান পার্শ্বে শয়ন করতেন । আর তিনি ফজরের কিছুক্ষণ পূর্বে বিশ্রাম নিলে তার হাতটা খাড়া করে হাতের চেটোর উপর মাথা রেখে আরাম করতেন ।’ আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘তোমরা রাতে সফর কর । কেননা, রাতে যমীনকে গুটিয়ে দেওয়া হয় ।’’ আবূ সা‘লাবা খুশানী (রাঃ) লোকেরা যখন কোন স্থানে অবতরণ করতেন, তখন তাঁরা গিরিপথ ও উপত্যকায় ছড়িয়ে যেতেন । রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তোমাদের এ সকল গিরিপথে ও উপত্যকায় বিক্ষিপ্ত হওয়া শয়তানের কাজ ।’’ এরপর তাঁরা যখনই কোন মঞ্জিলে অবতরণ করতেন, তখন একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে থাকতেন । সাহ্ল ইবনে আম্র (রাঃ) মতান্তরে সাহ্ল ইবনে রাবী ইবনে আম্র (রাঃ) আনসারী --যিনি ইবনুল হানযালিয়্যাহ নামে প্রসিদ্ধ এবং ইনি বায়আতে রিযওয়ানে অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটা উটের পাশ দিয়ে গেলেন, যার পিঠটা (দুর্বলতার কারণে) পেটের সাথে লেগে গিয়েছিল । (তা দেখে) তিনি বললেন, ‘‘তোমরা এ সব অবলা জন্তুর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর । সুতরাং তোমরা তাদের সুস্থ থাকা অবস্থায় আরোহণ কর এবং তাদের সুস্থ থাকা অবস্থায় মাংস খাও ।’’ (আবু দাঊদ, বিশুদ্ধ সূত্রে) আবূ জা‘ফর আব্দুল্লাহ ইবনে জা‘ফর (রাঃ) ‘একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে সওয়ারীর উপর তাঁর পিছনে বসালেন এবং আমাকে তিনি একটি গোপন কথা বললেন, যা আমি কাউকে বলব না । আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উঁচু জায়গা (দেওয়াল, ঢিবি ইত্যাদি) অথবা খেজুরের বাগানের আড়ালে মল-মূত্র ত্যাগ করা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন ।’ (ইমাম মুসলিম এটিকে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন) বারক্বানী এতে মুসলিমের সূত্রে বর্ধিত আকারে ‘খেজুরের বাগান’ শব্দের পর বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক আনসারীর বাগানে প্রবেশ ক’রে সেখানে একটা উট দেখতে পেলেন । উটটা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল এবং তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কাছে এসে তার কুঁজে এবং কানের পিছনের অংশে হাত ফিরালেন, ফলে সে শান্ত হল । তারপর তিনি বললেন, ‘‘এই উটের মালিক কে ? এই উটটা কার ?’’ অতঃপর আনসারদের এক যুবক এসে বলল, ‘এটা আমার হে আল্লাহর রসূল !’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি কি এই পশুটার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো না, আল্লাহ তোমাকে যার মালিক বানিয়েছেন ? কারণ, সে আমার নিকট অভিযোগ করছে যে, তুমি তাকে ক্ষুধায় রাখ এবং (বেশি কাজ নিয়ে) ক্লান্ত করে ফেলো !’’ আনাস (রাঃ) ‘আমরা যখন (সফরে) কোন মঞ্জিলে অবতরণ করতাম, তখন সওয়ারীর পালান নামাবার পূর্বে নফল নামায পড়তাম না ।’

【4】

সফরের সঙ্গীকে সাহায্য করা প্রসঙ্গে

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) একদা আমরা সফরে ছিলাম । ইত্যবসরে এক ব্যক্তি তার সওয়ারীর উপর চড়ে এল । অতঃপর তার দৃষ্টি ডানে ও বামে ফেরাতে লাগল । রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘যার বাড়তি সওয়ারী আছে, সে যেন তা তাকে দেয় যার সওয়ারী নেই এবং যার অতিরিক্ত সফরের সম্বল রয়েছে, সে যেন সম্বলহীন ব্যক্তিকে দেয় ।’’ অতঃপর তিনি আরো কয়েক প্রকার মালের কথা বললেন । এমনকি শেষ পর্যন্ত আমরা ধারণা করলাম যে, বাড়তি মালে আমাদের কারোর কোন অধিকারই নেই । (মুসলিম) জাবের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন । অতঃপর তিনি বললেন, ‘‘হে মুহাজির ও আনসারের দল ! তোমাদের ভাইদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে, যাদের কোন মাল নেই, স্বগোত্রীয় লোকও নেই । সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে যেন দুই অথবা তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে নেয় । কারণ, আমাদের কারো এমন কোন সওয়ারী নেই, যা তাদের সাথে পালাক্রমে ছাড়া তাকে বহন করতে পারে ।’’ জাবের (রাঃ) বলেন, সুতরাং আমি দু’জন অথবা তিনজনকে সাথে নিলাম । অন্যান্যদের মত আমার উটেও তাদের সাথে পালাক্রমে চড়তাম । ৯৭৮। উক্ত রাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সফরে (সকলের) পিছনে চলতেন । তিনি দুর্বলকে চলতে সাহায্য করতেন এবং তাকে পিছনে বসিয়ে নিতেন ও তার জন্য দুআ করতেন ।

【5】

কোন সওয়ারী বা যানবাহনে চড়ার সময় দুআ

ইবনে উমার (রাঃ) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সফরে বেরিয়ে উটের পিঠে স্থির হয়ে বসতেন, তখন তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ পড়ে এই দুআ পড়তেন, ‘সুবহানাল্লাযী সাখখারা লানা হা-যা অমা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন । অইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনক্বালিবূন । আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফী সাফারিনা হা-যাল বির্রা অত্তাক্বওয়া, অমিনাল আমালি মা তারদ্বা । আল্লাহুম্মা হাওবিন আলাইনা সাফারানা হা-যা অত্ববি আন্না বু‘দাহ । আল্লাহুম্মা আন্তাস সা-হিবু ফিস সাফারি অলখালীফাতু ফিল আহল । আল্লাহুম্মা ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিন অ‘সাইস সাফার অকাআবাতিল মানযার, অসূইল মুনক্কালাবি ফিল মা-লি অল আহ্লি অল অলাদ।’ অর্থাৎ পবিত্র ও মহান যিনি একে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সমর্থ ছিলাম না । অবশ্যই আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তনকারী । ওগো আল্লাহ ! নিশ্চয় আমরা তোমার কাছে প্রার্থনা করছি আমাদের এই যাত্রায় পুণ্যকর্ম, সংযমশীলতা এবং তোমার সন্তোষজনক কার্যকলাপ । হে আল্লাহ ! আমাদের এ যাত্রাকে আমাদের জন্য সহজ ক’রে দাও । আমাদের থেকে ওর দূরত্ব গুটিয়ে নাও । হে আল্লাহ ! তুমিই সফরের সঙ্গী । আর পরিবার পরিজনের জন্য (আমাদের) প্রতিনিধি । হে আল্লাহ ! সফরের কষ্ট ও ক্লান্তি থেকে, ভয়ংকর দৃশ্য থেকে এবং বাড়ি ফিরে ধন-সম্পদ, পরিবার ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কোন অপ্রীতিকর দৃশ্য থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি । আর বাড়ি ফিরার সময় উক্ত দুআর সাথে এগুলিও পড়তেন, ‘আ-ইবূনা, তা-ইবূনা ‘আ-বিদূনা, লিরাব্বিনা হা-মিদূন।’ (মুসলিম) আব্দুল্লাহ ইবনে সার্জিস (রাঃ) তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন সফর করতেন, তখন তিনি সফরের কষ্ট থেকে, দুশ্চিন্তাজনক পরিস্থিতি থেকে বা অপ্রীতিকর প্রত্যাবর্তন, পূর্ণতার পর হ্রাস থেকে, অত্যাচারিতের বদ্দুআ থেকে, মাল-ধন ও পরিবারের ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর দৃশ্য থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন । (মুসলিম) আলী ইবনে রাবীআহ (রাঃ) তিনি বলেন, আমি আলী ইবনে আবু ত্বালেব (রাঃ)-এর নিকট হাজির ছিলাম । যখন তাঁর নিকট আরোহন করার উদ্দেশ্যে বাহন আনা হল এবং যখন তিনি বাহনের পাদানে স্বীয় পা রাখলেন তখন ‘বিসমিল্লাহ’ বললেন । অতঃপর যখন তার পিঠে স্থির হয়ে সোজাভাবে বসলেন তখন বললেন, ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাযী সাখখারা লানা হা-যা অমা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন । অইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনক্বালিবূন ।’ অতঃপর তিনবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়লেন । অতঃপর তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ পড়লেন । অতঃপর পড়লেন, ‘সুবহানাকা ইন্নী যালামতু নাফ্সী ফাগফিরলী, ইন্নাহু লা য়্যাগফিরুয্ যুনূবা ইল্লা আন্ত্।’ অতঃপর তিনি হাসলেন । তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আমীরুল মু’মিনীন ! আপনি হাসলেন কেন ?’ তিনি বললেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখলাম, তিনি তাই করলেন, যা আমি করলাম । অতঃপর তিনি হাসলেন । আমি প্রশ্ন করলাম, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আপনি হাসলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘‘তোমার মহান প্রতিপালক তাঁর সেই বান্দার প্রতি আশ্চর্যান্বিত হন, যখন সে বলে, ‘ইগফিরলী যুনূবী’ (অর্থাৎ আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দাও ।) সে জানে যে, আমি (আল্লাহ) ছাড়া পাপরাশি আর কেউ মাফ করতে পারে না ।’’ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী হাসান, কোন কোন কপিতে আছে, ‘হাসান সহীহ’। আর এ শব্দমালা আবূ দাঊদের।)

【6】

উঁচু জায়গায় চড়ার সময় মুসাফির ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে এবং নীচু জায়গায় নামবার সময় ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। ‘তক্বীর’ ইত্যাদি বলার সময় অত্যন্ত উচ্চঃস্বরে বলা নিষেধ

জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, আমরা (সফরে) যখন উঁচু জায়গায় চড়তাম তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলতাম এবং নীচু জায়গায় নামতাম, তখন ‘সুবহানাল্লাহ’ বলতাম । (বুখারী) ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সেনা বাহিনী যখন উঁচু জায়গায় চড়তেন তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন । আর যখন নিচু জায়গায় নামতেন তখন ‘সুবহানাল্লাহ’ বলতেন । (আবূ দাঊদ, বিশুদ্ধ সানাদে) উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হজ্জ কিংবা উমরাহ সেরে ফিরে আসতেন, যখনই কোন পাহাড়ী উঁচু জায়গায় অথবা ঢিবিতে চড়তেন তখনই তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন । অতঃপর তিনি বলতেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা শারীকা লাহ, লাহুল মুল্কু অলাহুল হামদু অহুওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর । আ-ইয়বূনা তা-ইবূনা সা-জিদূনা লিরাব্বিনা হা-মিদূন । সাদাক্বাল্লাহু ওয়া’দাহ, অনাসারা আব্দাহ্, অহাযামাল আহযাবা অহদাহ ।’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই । তাঁরই সার্বভৌম অধিকার, যাবতীয় প্রশংসা তাঁরই জন্য, আর তিনি প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান । আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তওবাকারী, ইবাদতগুযার, সাজদাহকারী, আমাদের প্রভুর প্রশংসাকারী । আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য প্রমাণিত করেছেন, তাঁর বান্দাহকে মদদ করেছেন এবং একাই শত্রু বাহিনীকে পরাস্ত করেছেন । আবূ হুরাইরা (রাঃ) এক ব্যক্তি নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আমি ইচ্ছা করেছি, সফরে যাব, আমাকে উপদেশ দিন ।’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি আল্লাহ-ভীতি অবলম্বন করো এবং প্রত্যেক উঁচু স্থানে নিয়মিত ‘আল্লাহু আকবার’ পড়ো ।’’ যখন লোকটা পিছন ফিরে যেতে লাগল, তখন তিনি (তার জন্য দুআ করে) বললেন, ‘‘আল্লাহুম্মাত্ববি লাহুল বু‘দা অহাওবিন আলাইহিস সাফার ।’’ অর্থাৎ হে আল্লাহ ! তুমি ওর পথের দূরত্ব গুটিয়ে দিয়ো এবং ওর জন্য সফর আসান ক’রে দিয়ো । (তিরমিযী হাসান) আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সফরে ছিলাম । আমরা যখন কোন উঁচু উপত্যকায় চড়তাম তখন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ বলতাম । (একদা) আমাদের শব্দ উঁচু হয়ে গেল । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, ‘‘হে লোক সকল ! তোমরা নিজেদের প্রতি নম্রতা প্রদর্শন কর । কেননা, তোমরা কোন বধির ও অনুপস্থিতকে ডাকছ না । তিনি তো তোমাদের সঙ্গেই রয়েছেন । তিনি সর্বশ্রোতা ও নিকটবর্তী ।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

【7】

সফরে দুআ করা মুস্তাহাব

আবূ আব্দুল্লাহ (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘তিন জনের দুআ সন্দেহাতীতভাবে গৃহীত হয়ঃ (১) নির্যাতিত ব্যক্তির দুআ, (২) মুসাফিরের দুআ এবং (৩) ছেলের জন্য মাতা-পিতার বদ্দুয়া।’’ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী হাসান)

【8】

মানুষ বা অন্য কিছু থেকে ভয় পেলে কী দুআ পড়বে?

আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন কোন শত্রুদলকে ভয় করতেন তখন এই দুআ পড়তেন, ‘‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাজ‘আলুকা ফী নুহূরিহিম অনাঊযু বিকা মিন শুরূরিহিম ।’’ অর্থাৎ হে আল্লাহ ! আমরা তোমাকে ওদের মুখোমুখি করছি এবং ওদের অনিষ্টকারিতা থেকে তোমার নিকট পানাহ চাচ্ছি ।

【9】

কোন মঞ্জিলে (বিশ্রাম নিতে) অবতরণ করলে সেখানে কী দুআ পড়বে?

খাওলা বিনতে হাকীম (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে বলতে শুনেছি যে, ‘‘যে ব্যক্তি (সফরের) কোন মঞ্জিলে নেমে এই দুআ পড়বে, ‘আঊযু বিকালিমাতিল্লা-হিত্ তা-ম্মাতি মিন শার্রি মা খালাক্ব।’ (অর্থাৎ আল্লাহর পরিপূর্ণ বাণীসমূহের অসীলায় তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আমি আশ্রয় চাচ্ছি।) তাহলে সে মঞ্জিল থেকে অন্যত্র রওনা হওয়া পর্যন্ত কোন জিনিস তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (মুসলিম) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন সফর করতেন এবং সফরে রাত্রি হয়ে যেতো, তখন তিনি বলতেনঃ ইয়া আরযু রাব্বী ও রাব্বুকিল্লাহ, আ‘উযু বিল্লাহি মিন শাররিকি ওয়া শাররি মা ফীকি ওয়া শাররি মা খুলিক্বা ফীকি ওয়া শাররি মা ইয়াদিববু আলাইকি, আ‘উযু বিল্লাহি মিন শাররি আসাদিন ওয়া আসওয়াদিন ওয়া মিনাল হাইয়্যাতি ওয়াল আক্বরাবি ওয়া মিন সাকিনিল বালাদি ওয়া মিন ওয়ালিদিও ওয়ামা ওয়ালাদ (হে মাটি ! তোমার ও আমার প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা । আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি । তোমার অনিষ্ট থেকে, তোমার ভিতরে যা আছে তার অনিষ্ট থেকে তোমার ভিতরে যা সৃষ্টি করা হয়েছে তার অনিষ্ট থেকে এবং যা কিছু তোমার উপরে বিচরণ করে তার অনিষ্ট থেকে । আর আমি আল্লাহর নিকট বাঘ ও কাল সাপ হতে এবং সর্ব প্রকারের সাপ, বিচ্ছু হতে আর শহরবাসীদের অনিষ্টকারিতা হতে এবং জম্মদানকারী ও জন্মলাভকারীর অনিষ্টকারিতা হতে আশ্রয় চাই) । (আবূ দাঊদ) (আমি (আলবানী) বলছিঃ হাদীসটির সনদে অজ্ঞতা রয়েছে যদিও হাদীসটিকে হাকিম ও যাহাবী সহীহ্ আখ্যা দিয়েছেন আর আসকালানী হাসান আখ্যা দিয়েছেন ।

【10】

প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে সফর থেকে অতি শীঘ্র বাড়ি ফিরা মুস্তাহাব

আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘সফর আযাবের অংশ বিশেষ । সফর তোমাদেরকে পানাহার ও নিদ্রা থেকে বিরত রাখে । সুতরাং যখন তোমাদের কারোর সফরের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবে, তখন সে যেন বাড়ি ফিরার জন্য তাড়াতাড়ি করে ।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

【11】

সফর শেষে বাড়িতে দিনের বেলায় আসা উত্তম এবং অপ্রয়োজনে রাতের বেলায় ফিরা অনুত্তম

জাবের (রাঃ) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যখন তোমাদের কারোর বিদেশের অবস্থান দীর্ঘ হবে, তখন সে যেন অবশ্যই রাত্রিকালে নিজ গৃহে না ফিরে ।’’ (বুখারী ও মুসলিম) আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সফর শেষে রাত্রিকালে স্বীয় বাড়ি ফিরতেন না । তিনি সকালে কিংবা বিকালে বাড়ি আগমন করতেন ।’

【12】

সফর থেকে বাড়ি ফিরার সময় এবং নিজ গ্রাম বা শহর দেখার সময় দুআ

আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, একদা আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে সফর থেকে ফিরে এলাম । পরিশেষে যখন মদীনার উপকণ্ঠে এসে উপনীত হলাম, তখন তিনি এই দুআ পড়লেন, ‘আ-ইবূনা, তা-ইবূনা, ‘আ-বিদূনা, লিরাব্বিনা হা-মিদূন । (অর্থাৎ আমরা সফর থেকে প্রত্যাগমনকারী, তওবাকারী, উপাসনাকারী, আমাদের প্রভুর প্রশংসাকারী ।) মদীনায় আগমন না করা পর্যন্ত তিনি এ দুআ অনবরত পড়তে থাকলেন । (মুসলিম)

【13】

সফর থেকে বাড়ি ফিরে প্রথমে বাড়ির নিকটবর্তী কোন মসজিদে দু’ রাকআত নফল নামায পড়া মুস্তাহাব

কা‘ব ইবনে মালেক (রাঃ) ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন সফর থেকে বাড়ি ফিরতেন, তখন সর্বপ্রথম মসজিদে গিয়ে দু’ রাকআত নামায পড়তেন ।’ (বুখারী ও মুসলিম)

【14】

কোনো মহিলার একাকিনী সফর করা হারাম

আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি যে নারী ঈমান রাখে, তার মাহরামের সঙ্গ ছাড়া একাকিনী এক দিন এক রাতের দূরত্ব সফর করা বৈধ নয় ।’’ (বুখারী ও মুসলিম) ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, ‘‘কোন পুরুষ যেন কোন বেগানা নারীর সঙ্গে তার সাথে এগানা পুরুষ ছাড়া অবশ্যই নির্জনতা অবলম্বন না করে । আর মাহরাম ব্যতিরেকে কোন নারী যেন সফর না করে ।’’ এক ব্যক্তি আবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আমার স্ত্রী হজ্জ পালন করতে বের হয়েছে । আর আমি অমুক অমুক যুদ্ধে নাম লিখিয়েছি ।’ তিনি বললেন, ‘‘যাও, তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ্জ কর ।’’ (বুখারী ও মুসলিম)