9. বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলত প্রসঙ্গে
পবিত্র কুরআন পড়ার ফযীলত
আবূ উমামাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, “তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ কর । কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে ।”(মুসলিম) নাওয়াস ইবনে সামআন (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, “কুরআন ও ইহজগতে তার উপর আমলকারীদেরকে (বিচারের দিন মহান আল্লাহর সামনে) পেশ করা হবে । সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে ইমরান তার আগে আগে থাকবে এবং তাদের পাঠকারীদের স্বপক্ষে (প্রভুর সঙ্গে) বাদানুবাদে লিপ্ত হবে । উসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিখে ও অপরকে শিক্ষা দেয় ।”(বুখারী) আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “কুরআনের (শুদ্ধ ভাবে পাঠকারী ও পানির মত হিফয্কারী পাকা) হাফেয মহাসম্মানিত পুণ্যবান লিপিকার (ফেরেশতাবর্গের) সঙ্গী হবে । আর যে ব্যক্তি (পাকা হিফ্য না থাকার কারণে) কুরআন পাঠে ‘ওঁ-ওঁ’ করে এবং পড়তে কষ্টবোধ করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব।” (একটি তেলাওয়াত ও দ্বিতীয়টি কষ্টের দরুন।) আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “কুরআন পাঠকারী মুমিনের উদাহরণ হচ্ছে ঠিক কমলা লেবুর মত; যার ঘ্রাণ উত্তম এবং স্বাদও উত্তম । আর যে মুমিন কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক খেজুরের মত; যার (উত্তম) ঘ্রাণ তো নেই, তবে স্বাদ মিষ্ট। (অন্যদিকে) কুরআন পাঠকারী মুনাফিকের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুগন্ধিময় (তুলসী) গাছের মত; যার ঘ্রাণ উত্তম, কিন্তু স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক মাকাল ফলের মত; যার (উত্তম) ঘ্রাণ নেই, স্বাদও তিক্ত।” উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “মহান আল্লাহ এই গ্রন্থ (কুরআন মাজীদ) দ্বারা (তার উপর আমলকারী) জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটান এবং এরই দ্বারা (এর অবাধ্য) অন্য গোষ্ঠীর পতন সাধন করেন ।” আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “দু’জনের ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা সিদ্ধ । (১) যাকে আল্লাহ কুরআন (মুখস্থ করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে ওর (আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে । (২) যাকে আল্লাহ তা‘আলা মালধন দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর পথে) দিন-রাত ব্যয় করে ।” বারা’ ইবনে আযেব (রাঃ) তিনি বলেন, একদা একটি লোক সূরা কাহাফ পাঠ করছিল । তার পাশেই দুটো রশি দিয়ে একটি ঘোড়া বাঁধা ছিল । ইতোমধ্যে লোকটিকে একটি মেঘে ঢেকে নিলো । মেঘটি লোকটির নিকটবর্তী হতে থাকলে ঘোড়াটি তা দেখে চমকাতে আরম্ভ করল । অতঃপর যখন সকাল হলো তখন লোকটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দরবারে হাজির হয়ে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করল । তা (শুনে) তিনি বললেন, “ওটি প্রশান্তি ছিল, যা তোমার কুরআন পড়ার দরুন অবতীর্ণ হয়েছে ।” আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন মাজীদ)এর একটি বর্ণ পাঠ করবে, তার একটি নেকী হবে । আর একটি নেকী দশটি নেকীর সমান হয় । আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি বর্ণ; বরং আলিফ একটি বর্ণ, লাম একটি বর্ণ এবং মীম একটি বর্ণ ।” (অর্থাৎ তিনটি বর্ণ দ্বারা গঠিত ‘আলিফ-লাম-মীম, যার নেকীর সংখ্যা হবে ত্রিশ । আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: কুরআনের কোনো অংশই যে ব্যক্তির পেটে নেই সে (সেই পেট বা উদর) বিরান ঘরের সমতুল্য । (তিরমিযি) যইফ । (আমি (আলবানী) বলছিঃ অর্থাৎ যে কুরআনের কিছু অংশ হেফয না করবে । হাদীসটির দুর্বল হওয়ার ব্যাপারে আমি “আলমিশকাত” গ্রন্থে (নং ২১৩৫) আলোচনা করেছি । হাদীসটির সনদকে “মুসনাদু আহমাদ” এর তাহকীক্ব করতে গিয়ে শু‘য়াইব আলআরনাঊতও দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন । এর সনদে কাবূস ইবনু আবী যিবইয়ান নামক এক বর্ণনাকারী রয়েছেন তিনি দুর্বল । আব্দুল্লাহ ইবনে আম্র ইবনে আস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “পবিত্র কুরআনের পাঠক, হাফেয ও তার উপর আমলকারীকে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, ‘তুমি কুরআন করীম পড়তে থাক ও চড়তে থাক । আর ঠিক সেইভাবে স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে পড়তে থাক, যেভাবে দুনিয়াতে পড়তে । কেননা, (জান্নাতের ভিতর) তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে, যেখানে তোমার শেষ আয়াতটি খতম হবে ।
কুরআন মাজীদ সযত্নে নিয়মিত পড়া ও তা ভুলে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশ
আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “এই কুরআনের প্রতি যত্ন নাও (অর্থাৎ, নিয়মিত পড়তে থাক ও তার চর্চা রাখ ।) সেই মহান সত্তার কসম, যাঁর হাতে মুহাম্মদের জীবন আছে, উট যেমন তার রশি থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃত হয়ে) যায় ।” (অর্থাৎ অতিশীঘ্র ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে ।) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “কুরআন-ওয়ালা হল বাঁধা উট-ওয়ালার মত । সে যদি তা বাঁধার পর তার যথারীতি দেখাশোনা করে, তাহলে বাঁধাই থাকবে । নচেৎ ঢিল দিলেই উট পালিয়ে যাবে ।”
সুললিত কণ্ঠে কুরআন পড়া মুস্তাহাব । মধুরকণ্ঠ কারীকে তা পড়ার আবেদন করা ও তা মনোযোগ সহকারে শোনা প্রসঙ্গে
আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, “মহান আল্লাহ এভাবে উৎকর্ণ হয়ে কোন কথা শোনেন না, যেভাবে সেই মধুরকণ্ঠী পয়গম্বরের প্রতি উৎকর্ণ হয়ে শোনেন, যিনি মধুর কণ্ঠে উচ্চ স্বরে কুরআন মাজীদ পড়তেন ।” (বুখারী, মুসলিম) আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে বললেন, “তোমাকে দাউদের সুললিত কণ্ঠের মত মধুর কণ্ঠ দান করা হয়েছে ।” (বুখারী, মুসলিম) বারা’ ইবনে আযেব (রাঃ) তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এশার নামাযে সূরা ‘অততীন অযযাইতূন’ পড়তে শুনেছি । বস্তুতঃ আমি তাঁর চেয়ে মধুর কণ্ঠ আর কারো শুনিনি ।” (বুখারী, মুসলিম) আবূ লুবাবাহ বাশীর ইবনে আব্দুল মুনযির (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিষ্ট স্বরে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের মধ্যে নয় ।” (অর্থাৎ আমাদের ত্বরীকা ও নীতি-আদর্শ বহির্ভূত ।) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, “(হে ইবনে মাসঊদ !) আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও ।” আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আমি আপনাকে পড়ে শোনাব, অথচ আপনার উপরে তা অবতীর্ণ করা হয়েছে ?’ তিনি বললেন, “অপরের মুখ থেকে (কুরআন পড়া) শুনতে আমি ভালবাসি ।” সুতরাং তাঁর সামনে আমি সূরা নিসা পড়তে লাগলাম, পড়তে পড়তে যখন এই (৪১নং) আয়াতে পৌঁছলাম---যার অর্থ, “তখন তাদের কি অবস্থা হবে, যখন প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকেও তাদের সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব ?” তখন তিনি বললেন, “যথেষ্ট, এখন থাম ।” অতঃপর আমি তাঁর দিকে ফিরে দেখি, তাঁর নয়ন যুগল অশ্রু ঝরাচ্ছে ।
বিশেষ বিশেষ সূরা ও আয়াত পাঠ করার উপর উৎসাহ দান
আবূ সাঈদ রাফে’ ইবনে মুআল্লা (রাঃ) তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, “মসজিদ থেকে বের হবার পূর্বেই তোমাকে কি কুরআনের সবচেয়ে বড় (মাহাত্ম্যপূর্ণ) সূরা শিখিয়ে দেব না ?” এই সাথে তিনি আমার হাত ধরলেন । অতঃপর যখন আমরা বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম, তখন আমি নিবেদন করলাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ ! আপনি যে আমাকে বললেন, তোমাকে অবশ্যই কুরআনের সবচেয়ে বড় (মাহাত্ম্যপূর্ণ) সূরা শিখিয়ে দেব ?’ সুতরাং তিনি বললেন, “(তা হচ্ছে) ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ (সূরা ফাতেহা) । এটি হচ্ছে ‘সাবউ মাসানী’ (অর্থাৎ নামাযে বারংবার পঠিতব্য সপ্ত আয়াত) এবং মহা কুরআন; যা আমাকে দান করা হয়েছে ।” আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (সূরা) ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ সম্পর্কে বলেছেন, “সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ আছে, নিঃসন্দেহে এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল ।” অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবাগণকে বললেন, ‘তোমরা কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়তে অপারগ ?’ প্রস্তাবটি তাঁদের পক্ষে ভারী মনে হল । তাই তাঁরা বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল ! এ কাজ আমাদের মধ্যে কে করতে পারবে ?’ (অর্থাৎ কেউ পারবে না ।) তিনি বললেন, “ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস স্বামাদ’ (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল ।” (অর্থাৎ, এই সূরা পড়লে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়ার সমান নেকী অর্জিত হয়) (বুখারী) উক্ত সাহাবী (রাঃ) এক ব্যক্তি কোন লোককে সূরাটি বারবার পড়তে শুনল । অতঃপর সে সকালে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে তা ব্যক্ত করল । সে সূরাটিকে নগণ্য মনে করছিল । রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “সেই সত্তার শপথ ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে, নিঃসন্দেহে এই সূরা (ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান ।” (বুখারী) আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (সূরা) ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ সম্পর্কে বলেছেন, “নিঃসন্দেহে এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য ।” (মুসলিম) আনাস (রাঃ) এক ব্যক্তি নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আমি এই (সূরা) ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ভালবাসি ।’ তিনি বললেন, “এর ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে ।” উক্ববাহ ইবন আমের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদা বললেন, “তুমি কি দেখনি, আজ রাত্রে আমার উপর কতকগুলি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে; যার অনুরূপ আর কিছু দেখা যায়নি ? (আর তা হল,) ‘ক্বুল আঊযু বিরাব্বিল ফালাক্ব’ ও ‘ক্বুল আঊযু বিরাব্বিন নাস।” আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) ‘রাসূলুল্লাহ (সূরা ফালাক্ব ও নাস অবতীর্ণ হবার পূর্ব পর্যন্ত নিজ ভাষাতে) জিন ও বদ নজর থেকে (আল্লাহর) আশ্রয় প্রার্থনা করতেন । পরিশেষে যখন উক্ত সূরা দু’টি অবতীর্ণ হল, তখন ঐ সূরা দু’টি দ্বারা আশ্রয় প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং অন্যান্য সব পরিহার করলেন ।’ আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “কুরআনে ত্রিশ আয়াতবিশিষ্ট একটি সূরা এমন আছে, যা তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং শেষাবধি তাকে ক্ষমা ক’রে দেওয়া হবে, সেটা হচ্ছে ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিয়্যাদিহিল মুল্ক’ (সূরা মুল্ক) ।” আবূ মাসঊদ বদরী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ আয়াত দু’টি পাঠ করবে, তার জন্য সে দু’টি যথেষ্ট হবে ।” (বুখারী, মুসলিম) আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা নিজেদের ঘর-বাড়িগুলোকে কবরে পরিণত করো না । কেননা, যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয়, সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে ।” (মুসলিম) উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “হে আবূ মুনযির ! তুমি কি জান, মহান আল্লাহর গ্রন্থ (আল-কুরআন) এর ভিতর তোমার যা মুখস্থ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় (মর্যাদাপূর্ণ) আয়াত কোন্টি ?” আমি বললাম, ‘সেটা হচ্ছে আয়াতুল কুরসি ।’ সুতরাং তিনি আমার বুকে চাপড় মেরে বললেন, “আবুল মুনযির ! তোমার জ্ঞান তোমাকে ধন্য করুক ।” (মুসলিম) আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, (একবার) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে রমযানের যাকাত (ফিৎরার মাল-ধন) দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন । বস্তুতঃ (আমি পাহারা দিচ্ছিলাম ইত্যবসরে) একজন আগমনকারী এসে আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল । আমি তাকে ধরলাম এবং বললাম, ‘তোকে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে পেশ করব ।’ সে আবেদন করল, ‘আমি একজন সত্যিকারের অভাবী । পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আমার উপর, আমার দারুণ অভাব ।’ কাজেই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম । সকালে (রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট হাযির হলাম ।) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “হে আবূ হুরাইরা ! গত রাতে তোমার বন্দী কি আচরণ করেছে ?” আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল ! সে তার অভাব ও (অসহায়) পরিবার-সন্তানের অভিযোগ জানাল । সুতরাং তার প্রতি আমার দয়া হলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম ।’ তিনি বললেন, “সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে ।” আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনুরূপ উক্তি শুনে সুনিশ্চিত হলাম যে, সে আবার আসবে । কাজেই আমি তার প্রতীক্ষায় থাকলাম । সে (পূর্ববৎ) এসে আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল । আমি তাকে বললাম, ‘অবশ্যই তোকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দরবারে পেশ করব ।’ সে বলল, ‘আমি অভাবী, পরিবারের দায়িত্ব আমার উপর, (আমাকে ছেড়ে দাও) আমি আর আসব না ।’ সুতরাং আমার মনে দয়া হল । আমি তাকে ছেড়ে দিলাম । সকালে উঠে (যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে গেলাম তখন) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, “আবূ হুরাইরা ! গত রাত্রে তোমার বন্দী কিরূপ আচরণ করেছে ?” আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ ! সে তার অভাব ও অসহায় সন্তান-পরিবারের অভিযোগ জানাল । সুতরাং আমার মনে দয়া হলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম ।’ তিনি বললেন, “সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে ।” সুতরাং তৃতীয়বার তার প্রতীক্ষায় রইলাম । সে (এসে) আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল । আমি তাকে ধরে বললাম, “এবারে তোকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে হাযির করবই । এটা তিনবারের মধ্যে শেষবার । ‘ফিরে আসবো না’ বলে তুই আবার ফিরে এসেছিস ।” সে বলল, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে এমন কতকগুলি শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন ।’ আমি বললাম, ‘সেগুলি কি ?’ সে বলল, ‘যখন তুমি (ঘুমাবার জন্য) বিছানায় যাবে, তখন আয়াতুল কুরসি পাঠ করে (ঘুমাবে) । তাহলে তোমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত হবে । আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না ।’ সুতরাং আমি তাকে ছেড়ে দিলাম । আবার সকালে (রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে গেলাম ।) তিনি আমাকে বললেন, “তোমার বন্দী কি আচরণ করেছে ?” আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল ! সে বলল, “আমি তোমাকে এমন কতিপয় শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ আমার কল্যাণ করবেন ।” বিধায় আমি তাকে ছেড়ে দিলাম ।’ তিনি বললেন, “সে শব্দগুলি কি ?” আমি বললাম, ‘সে আমাকে বলল, “যখন তুমি বিছানায় (শোয়ার জন্য) যাবে, তখন আয়াতুল কুরসি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম’ পড়ে নেবে ।” সে আমাকে আরও বলল, “তার কারণে আল্লাহর তরফ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক নিযুক্ত থাকবে । আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসবে না ।” (এ কথা শুনে) তিনি বললেন, “শোনো ! সে নিজে ভীষণ মিথ্যাবাদী; কিন্তু তোমাকে সত্য কথা বলেছে । হে আবূ হুরাইরা ! তুমি জান, তিন রাত ধরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে ?” আমি বললাম, ‘জী না।’ তিনি বললেন, “সে শয়তান ছিল ।” (বুখারী) আবূ দার্দা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের (ফিতনা) থেকে পরিত্রাণ পাবে ।” অন্য বর্ণনায় ‘কাহাফ সূরার শেষ দিক থেকে’ উল্লেখ হয়েছে । (মুসলিম) (আমি (আলবানী) বলছিঃ দ্বিতীয় বর্ণনাটি শায আর প্রথম বর্ণনাটি নিরাপদ (সহীহ্) যেমনটি আমি “সিলসিলাহ্ সহীহাহ্” গ্রন্থে (নং ৫৮২) তাহকীক্ব করেছি । এর সাক্ষ্য দিচ্ছে নাওয়াস ইবনু সাম‘আনের আগত হাদীসটি । যেটিকে (১৮১৭) নম্বরে লেখক উল্লেখ করেছেন । কারণ এতে বলা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি দাজ্জালকে পেয়ে বসবে সে যেন তার বিপক্ষে সূরা কাহাফের প্রথম অংশ পাঠ করে । আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, একদা জিবরীল عليه السلام নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট বসে ছিলেন । এমন সময় উপর থেকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন । তিনি (জিবরীল) মাথা তুলে বললেন, ‘এটি আসমানের একটি দরজা, যা আজ খোলা হল । ইতোপূর্বে এটা কখনও খোলা হয়নি । ওদিক দিয়ে একজন ফিরিশ্তা অবতীর্ণ হল । এই ফিরিশ্তা যে দুনিয়াতে অবতরণ করেছে, ইতোপূর্বে কখনও অবতরণ করেনি ।’ সুতরাং তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সালাম জানিয়ে বললেন, “আপনি দু’টি জ্যোতির সুসংবাদ নিন । যা আপনার আগে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি । (সে দু’টি হচ্ছে) সূরা ফাতেহা ও সূরা বাক্বারার শেষ আয়াতসমূহ । ওর মধ্য হতে যে বর্ণটিই পাঠ করবেন, তাই আপনাকে দেওয়া হবে ।” (মুসলিম)
কুরআন পঠন-পাঠনের জন্য সমবেত হওয়া মুস্তাহাব
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখনই কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোন এক ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর গ্রন্থ (কুরআন) পাঠ করে, তা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে অধ্যয়ন করে, তাহলে তাদের প্রতি (আল্লাহর পক্ষ থেকে) প্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং তাদেরকে তাঁর রহমত ঢেকে নেয়, আর ফিরশ্তাবর্গ তাদেরকে ঘিরে ফেলেন । আল্লাহ স্বয়ং তাঁর নিকটস্থ ফিরিশ্তামণ্ডলীর কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন ।” (মুসলিম)
ওযূর ফযীলত
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, “নিশ্চয় আমার উম্মতকে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় ডাকা হবে, যে সময় তাদের ওযূর অঙ্গগুলো চমকাতে থাকবে । সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে তার চমক বাড়াতে চায়, সে যেন তা করে ।” (অর্থাৎ সে যেন তার ওযূর সীমার অতিরিক্ত অংশও ধুয়ে ফেলে ।) (বুখারী, মুসলিম) উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, আমি আমার বন্ধু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, “(পরকালে) মু’মিনের অলংকার ততদূর হবে, যতদূর তার ওযূর (পানি) পৌঁছবে।” (মুসলিম) উসমান ইবনে ‘আফ্ফান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযূ করবে, তার পাপসমূহ তার দেহ থেকে বেরিয়ে যাবে । এমনকি তার নখগুলোর নিচে থেকেও (পাপ) বেরিয়ে যাবে ।” উক্ত রাবী আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আমার এই ওযূর মত ওযূ করতে দেখলাম । অতঃপর তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি এরূপ ওযূ করবে, তার পূর্বকৃত পাপরাশি মাফ করা হবে এবং তার নামায ও মসজিদের দিকে চলার সওয়াব অতিরিক্ত হবে ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “মুসলিম কিংবা মুমিন বান্দাহ যখন ওযূ করবে এবং যখন সে নিজ মুখমণ্ডল ধৌত করবে, তখন তার মুখমণ্ডল হতে সেই গোনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যাবে, যে সব গোনাহ তার দু’টি চোখ দিয়ে দেখার ফলে সংঘটিত হয়েছিল । (অনুরূপভাবে) যখন সে নিজ হাত দু’টি ধোবে, তখন তা হতে সে সব পাপ পানির সাথে বা পানির শেষ বিন্দুর সাথে নির্গত হয়ে যাবে, যে সব পাপ তার দুই হাত দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল । আর যখন সে নিজ পা দু’টি ধৌত করবে, তখন তার পা দু’টি হতে সে সমস্ত পাপরাশি পানির সঙ্গে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সঙ্গে বের হয়ে যাবে, যেগুলি তার দু’টি পায়ে চলার ফলে সংঘটিত হয়েছিল । শেষ অবধি সে (ক্ষুদ্র) পাপরাশি হতে পাক-পবিত্র হয়ে বেরিয়ে আসবে ।” (মুসলিম) উক্ত রাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (একবার) কবরস্থানে এসে (কবরবাসীদের সম্বোধন ক’রে) বললেন, “হে (পরকালের) ঘরবাসী মুমিনগণ ! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষণ হোক । যদি আল্লাহ চান তো আমরাও তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব । আমার বাসনা যে, যদি আমরা আমাদের ভাইদেরকে দেখতে পেতাম ।” সাহাবীগণ নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আমরা কি আপনার ভাই নই ?’ তিনি বললেন, “তোমরা তো আমার সহচরবৃন্দ । আমার ভাই তারা, যারা এখনো পর্যন্ত আগমন করেনি ।” সাহাবীগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আপনার উম্মতের মধ্যে যারা এখনো পর্যন্ত আগমন করেনি, তাদেরকে আপনি কিভাবে চিনতে পারবেন ?’ তিনি বললেন, “আচ্ছা বল, যদি খাঁটি কাল রঙের ঘোড়ার দলে, কোনো লোকের কপাল ও পা সাদা দাগবিশিষ্ট ঘোড়া থাকে, তাহলে কি সে তার ঘোড়া চিনতে পারবে না ?” তাঁরা বললেন, ‘অবশ্যই পারবে, হে আল্লাহর রসূল !’ তিনি বললেন, “তারা এই অবস্থায় (হাশরের মাঠে) আগমন করবে যে, ওযূ করার দরুন তাদের হাত-পা চমকাতে থাকবে । আর আমি ‘হাওযে’-এ তাদের অগ্রগামী ব্যবস্থাপক হব ।” (অর্থাৎ তাদের আগেই আমি সেখানে পৌঁছে যাব ।) উক্ত রাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (একদা সমবেত সহচরদের উদ্দেশ্যে) বললেন, “তোমাদেরকে এমন একটি কাজ বলব না কি, যার দ্বারা আল্লাহ গোনাহসমূহকে মোচন করে দেবেন এবং (জান্নাতে) তার দ্বারা মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন ?” তাঁরা বললেন, ‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রসূল !’ তিনি বললেন, “(তা হচ্ছে) কষ্টকর অবস্থায় পরিপূর্ণরূপে ওযূ করা, অধিক মাত্রায় মসজিদে গমন করা এবং এক অক্তের নামায আদায় ক’রে পরবর্তী অক্তের নামাযের জন্য অপেক্ষা করা । আর এ হল প্রতিরক্ষা বাহিনীর মত কাজ । এ হল প্রতিরক্ষা বাহিনীর মত কাজ ।” (মুসলিম) আবূ মালেক আশআরী (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “(বাহ্যিক) পবিত্রতা অর্জন করা হল অর্ধেক ঈমান ।” (মুসলিম) উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পরিপূর্ণরূপে ওযূ ক’রে যে ব্যক্তি এই দুআ বলবে, ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহদাহু লা শারীকা লাহ, অ আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু অরাসূলুহ ।’ অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই । তিনি একক, তাঁর কোন অংশী নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দাস ও প্রেরিত দূত (রসূল) । তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা তাতে প্রবেশ করবে ।”(মুসলিম)
আযানের ফযীলত
আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “লোকেরা যদি জানত যে, আযান দেওয়া ও নামাযের প্রথম সারিতে দাঁড়াবার কি মাহাত্ম্য আছে, অতঃপর (তাতে অংশগ্রহণের জন্য) যদি লটারি ব্যতিরেকে অন্য কোনো উপায় না পেত, তবে তারা অবশ্যই সে ক্ষেত্রে লটারির সাহায্য নিত । (অনুরূপ) তারা যদি জানত যে, আগে আগে মসজিদে আসার কি ফযীলত, তাহলে তারা সে ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করত । আর তারা যদি জানত যে, এশা ও ফজরের নামায (জামাতে) পড়ার ফযীলত কত বেশি, তাহলে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বা পাছা ছেঁচড়ে আসতে হলেও তারা অবশ্যই আসত ।” (বুখারী-মুসলিম) মুআবিয়াহ ইবনে আবূ সুফয়ান (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এ কথা বলতে শুনেছি, “কিয়ামতের দিনে সমস্ত লোকের চাইতে মুয়ায্যিনদের গর্দান লম্বা হবে ।” আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে স্বা‘স্বাআহ একদা আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) তাঁকে বললেন, ‘আমি তোমাকে দেখছি যে, তুমি ছাগল ও মরুভূমি ভালোবাসো । সুতরাং তুমি যখন তোমার ছাগলে বা মরুভূমিতে থাকবে আর নামাযের জন্য আযান দেবে, তখন উচ্চ স্বরে আযান দিয়ো । কারণ মুয়ায্যিনের আযান ধ্বনি যতদূর পর্যন্ত মানব-দানব ও অন্যান্য বস্তু শুনতে পাবে, কিয়ামতের দিন তারা তার জন্য সাক্ষ্য দেবে ।’ আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, ‘আমি এটি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট শুনেছি ।’ (বুখারী) আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখন নামাযের জন্য আযান দেওয়া হয়, তখন শয়তান বাতকর্ম করতে করতে পিঠ ঘুরিয়ে পলায়ন করে, যাতে সে আযান শুনতে না পায় । তারপর আযান শেষ হলে ফিরে আসে । শেষ পর্যন্ত যখন ‘তাকবীর’ দেওয়া হয়, তখন আবার পিঠ ঘুরিয়ে পালায় । অতঃপর যখন ‘তাকবীর’ শেষ হয়, তখন আবার ফিরে আসে । পরিশেষে (নামাযী) ব্যক্তির মনে এই কুমন্ত্রণা প্রক্ষেপ করে যে, অমুক জিনিসটা স্মরণ কর, অমুক বস্তুটা খেয়াল কর । সে সমস্ত বিষয় (স্মরণ করায়) যা পূর্বে তার স্মরণে ছিল না । শেষ পর্যন্ত এ ব্যক্তি এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যে, সে বুঝতে পারে না, কত রাক‘আত নামায সে আদায় করল ।” (বুখারী, মুসলিম) আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আম্র ইবনে আ’স (রাঃ) তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছেন যে, “তোমরা যখন আযান শুনবে, তখন (আযানের উত্তরে) মুআয্যিন যা কিছু বলবে, তোমরাও ঠিক তাই বলবে । তারপর আযান শেষে আমার উপর দরূদ পাঠ করবে । কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে, তার বিনিময়ে তার প্রতি আল্লাহ দশটি রহমত নাযেল করবেন । অতঃপর তোমরা আল্লাহর নিকট আমার জন্য ‘অসীলা’ প্রার্থনা করবে । কারণ, ‘অসীলা’ হচ্ছে জান্নাতের এমন একটি স্থান, যা সমস্ত বান্দার মধ্যে কেবল আল্লাহর একটি বান্দা (তার উপযুক্ত) হবে । আর আশা করি, আমিই সেই বান্দা হব । সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্য অসীলা প্রার্থনা করবে, তার জন্য (আমার) সুপারিশ অনিবার্য হয়ে যাবে ।” (মুসলিম) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখন তোমরা আযান ধ্বনি শুনবে, তখন (আযানের উত্তরে) মুআয্যিন যা কিছু বলবে, তোমরাও ঠিক তাই বলো” (বুখারী, মুসলিম) জাবের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আযান শুনে (আযানের শেষে) এই দুআ বলবে, ‘আল্লা-হুম্মা রাব্বা হা-যিহিদ দা‘অতিত্ তা-ম্মাহ, অস্স্বালা-তিল ক্বা-য়িমাহ, আ-তি মুহাম্মাদানিল অসীলাতা অলফাযীলাহ, অবআষহু মাক্বা-মাম মাহমূদানিল্লাযী অ‘আত্তাহ ।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ এই পূর্ণা-ঙ্গ আহ্বান ও প্রতিষ্ঠা লাভকারী নামাযের প্রভু ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তুমি অসীলা (জান্নাতের এক উচ্চ স্থান) ও মর্যাদা দান কর এবং তাঁকে সেই প্রশংসিত স্থানে পৌঁছাও, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাঁকে দিয়েছ । সে ব্যক্তির জন্য কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ অনিবার্য হয়ে যাবে ।” (বুখারী) সা‘দ ইবনে আবী অক্কাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, “আযান শুনে যে ব্যক্তি এই দুআ পড়বে, ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহদাহু লা শারীকা লাহ, অ আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু অরাসূলুহ, রাদ্বীতু বিল্লা-হি রাব্বিঁউ অ বিমুহাম্মাদির রাসূলাঁউ অ বিলইসলা-মি দ্বীনা ।’ অর্থাৎ আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দাস ও প্রেরিত রসূল । আল্লাহকে প্রতিপালক বলে মেনে নিতে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবীরূপে স্বীকার করতে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করতে আমি সম্মত ও তুষ্ট হয়েছি । সে ব্যক্তির (ছোট ছোট) গুনাহ ক্ষমা ক’রে দেওয়া হবে ।” আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আযান ও ইকামতের মধ্য সময়ে কৃত প্রার্থনা রদ করা হয় না ।” (অর্থাৎ এ সময়ের দুআ কবুল হয়) ।
নামাযের ফযীলত
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এ কথা বলতে শুনেছেন, “আচ্ছা তোমরা বল তো, যদি কারোর বাড়ির দরজার সামনে একটি নদী থাকে, যাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার ক’রে গোসল করে, তাহলে তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে কি ?” সাহাবীগণ বললেন, ‘(না,) কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না ।’ তিনি বললেন, “পাঁচ অক্তের নামাযের উদাহরণও সেইরূপ । এর দ্বারা আল্লাহ পাপরাশি নিশ্চিহ্ন করে দেন ।” (বুখারী) জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “পাঁচ অক্তের নামাযের উদাহরণ ঠিক প্রবাহিত নদীর ন্যায়, যা তোমাদের কোনো ব্যক্তির দরজার পাশে থাকে; যাতে সে প্রত্যহ পাঁচবার ক’রে গোসল ক’রে থাকে ।” (মুসলিম) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) এক ব্যক্তি এক মহিলাকে চুমা দিয়ে ফেলে । অতঃপর সে (অনুতপ্ত হয়ে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে ঘটনাটি বলে । তখন আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করেন, যার অর্থ: “তুমি নামায প্রতিষ্ঠা কর দিবসের দুই প্রান্তে এবং রাত্রির প্রথম ভাগে, নিশ্চয় পুণ্য কর্মাদি পাপ-রাশিকে বিদূরিত ক’রে থাকে ।” (সূরা হুদ ১১৪ আয়াত) লোকটি বলল, ‘এ বিধান কি কেবল আমার জন্য ?’ তিনি বললেন, “আমার উম্মতের সকলের জন্য ।” (বুখারী মুসলিম) আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “পাঁচ অক্তের নামায, এক জুমআহ থেকে পরবর্তী জুমআহ পর্যন্ত এর মধ্যবর্তী সময়ে যেসব পাপ সংঘটিত হয়, সে সবের মোচন-কারী হয় (এই শর্তে যে,) যদি মহাপাপে লিপ্ত না হয় ।” (মুসলিম) উসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, “যে ব্যক্তি ফরয নামাযের জন্য ওযূ করবে এবং উত্তমরূপে ওযূ সম্পাদন করবে । (অতঃপর) তাতে উত্তমরূপে ভক্তি-বিনয়-নম্রতা প্রদর্শন করবে এবং উত্তমরূপে ‘রুকু’ সমাধা করবে । তাহলে তার নামায পূর্বে সংঘটিত পাপরাশির জন্য কাফ্ফারা (প্রায়শ্চিত্ত) হয়ে যাবে; যতক্ষণ মহাপাপে লিপ্ত না হবে । আর এ (রহমতে ইলাহির ধারা) সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য ।” (মুসলিম)
ফজর ও আসরের নামাযের ফযীলত
আবূ মূসা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুই ঠাণ্ডা নামায পড়ে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে ।” আবূ যুহাইর উমারাহ ইবনে রুআইবাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, “যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে (অর্থাৎ ফজরের ও আসরের নামায) আদায় করবে, সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না ।” (মুসলিম) জুন্দুব ইবনে সুফয়ান (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায পড়ল, সে আল্লাহর জামানত লাভ করল। অতএব হে আদম সন্তান! লক্ষ্য রাখ, আল্লাহ যেন অবশ্যই তোমাদের কাছে তার জামানতের কিছু দাবী না করেন ।” (মুসলিম) আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের নিকট দিবারাত্রি ফিরিশতাবর্গ পালাক্রমে যাতায়াত করতে থাকেন । আর ফজর ও আসরের নামাযে তাঁরা একত্রিত হন । অতঃপর যারা তোমাদের কাছে রাত কাটিয়েছেন, তাঁরা ঊর্ধ্বে (আকাশে) চলে যান । অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন---অথচ তিনি তাদের সম্পর্কে ভালভাবে পরিজ্ঞাত, ‘তোমরা আমার বান্দাদেরকে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছ ?’ তাঁরা বলেন, ‘আমরা যখন তাদেরকে ছেড়ে এসেছি, তখন তারা নামাযে প্রবৃত্ত ছিল । আর যখন আমরা তাদের নিকট গিয়েছিলাম, তখনও তারা নামাযে প্রবৃত্ত ছিল ।”(বুখারী ও মুসলিম) জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী (রাঃ) তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পূর্ণিমার রাতে বসে ছিলাম । তিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিঃসন্দেহে তোমরা (পরকালে) তোমাদের প্রতিপালককে ঠিক এইভাবে দর্শন করবে, যেভাবে তোমরা এই পূর্ণিমার চাঁদ দর্শন করছ । তাঁকে দেখতে তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না । সুতরাং যদি তোমরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের আগে (নিয়মিত) নামায পড়তে পরাহত না হতে সক্ষম হও (অর্থাৎ এ নামায ছুটে না যায়), তাহলে অবশ্যই তা বাস্তবায়ন কর ।” বুরাইদা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আসরের নামায ত্যাগ করল, নিঃসন্দেহে তার আমল নষ্ট হয়ে গেল ।”
মসজিদে যাওয়ার ফযীলত
আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকাল অথবা সন্ধ্যায় মসজিদে গমন করে, আল্লাহ তার জন্য আপ্যায়ন সামগ্রী জান্নাতের মধ্যে প্রস্তুত করেন । সে যতবার সকাল অথবা সন্ধ্যায় গমনাগমন করে, আল্লাহও তার জন্য ততবার আতিথেয়তার সামগ্রী প্রস্তুত করেন ।” উক্ত রাবী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি বাড়ি থেকে ওযূ ক’রে আল্লাহর কোনো ঘরের দিকে এই উদ্দেশ্যে যাত্রা করে যে, আল্লাহর নির্ধারিত কোনো ফরয ইবাদত (নামায) আদায় করবে, তাহলে তার কৃত প্রতিটি দুই পদক্ষেপের মধ্যে একটিতে একটি ক’রে গুনাহ মিটাবে এবং অপরটিতে একটি ক’রে মর্যাদা উন্নত করবে ।” উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) তিনি বলেন, এক আনসারী ছিল । মসজিদ থেকে তার চাইতে দূরে কোনো ব্যক্তি থাকত বলে আমার জানা নেই । তবুও সে কোনো নামায (মসজিদে জামাআতসহ) আদায় করতে ত্রুটি করত না । একদা তাকে বলা হল, ‘যদি একটা গাধা খরিদ করতে এবং রাতের অন্ধকারে ও উত্তপ্ত রাস্তায় তার উপর আরোহণ করতে, (তাহলে ভাল হত) ।’ সে বলল, ‘আমার বাসস্থান মসজিদের পার্শ্বে হলেও তা আমাকে আনন্দ দিতে পারত না । কারণ আমার মনস্কামনা এই যে, মসজিদে যাবার ও নিজ বাড়ি ফিরার সময় কৃত প্রতিটি পদক্ষেপ যেন লিপিবদ্ধ হয় ।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (তার এহেন পুণ্যাগ্রহ দেখে) বললেন, “নিশ্চিতরূপে আল্লাহ তোমার (ভাগ্যে) তা সমস্তই জুটিয়েছেন ।” জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, মসজিদে নববীর আশে-পাশে কিছু জায়গা খালি হল। (এ দেখে) সালেমা গোত্র মসজিদে (নববী)এর নিকট স্থানান্তরিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করল । এ খবর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতে পারলে তিনি তাদেরকে বললেন, “আমি জানতে পেরেছি যে, তোমরা মসজিদের কাছে চলে আসতে চাচ্ছ !” তারা বলল, ‘জী হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল! আমরা এ ইচ্ছা করেছি ।’ তিনি বললেন, “হে সালেমা গোত্র ! তোমরা নিজেদের (বর্তমান) বাড়িতেই থাক । তোমাদের (মসজিদের পথে) পদক্ষেপসমূহের চিহ্নগুলি লিপিবদ্ধ করা হবে । তোমরা নিজেদের (বর্তমান) বাড়িতেই থাক । তোমাদের (মসজিদের পথে) পদক্ষেপসমূহের চিহ্নগুলি লিপিবদ্ধ করা হবে ।” তারা বলল, ‘(মসজিদের নিকট) স্থানান্তরিত হওয়া আমাদেরকে আনন্দ দেবে না ।’ আবূ মূসা (রাঃ) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “(মসজিদে জামাআতসহ) নামায পড়ার ক্ষেত্রে, সেই ব্যক্তি সর্বাধিক বেশী নেকী পায়, যে ব্যক্তি সব চাইতে দূর-দূরান্ত থেকে আসে । আর যে ব্যক্তি (জামাতের সাথে) নামাযের অপেক্ষা না করেই একা নামায পড়ে শুয়ে যায়, তার চাইতে সেই বেশী নেকী পায়, যে নামাযের জন্য প্রতীক্ষা করে ও ইমামের সাথে জামাআত সহকারে নামায আদায় করে ।” বুরাইদাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “রাত্রির অন্ধকারে মসজিদে যাতায়াতকারী লোকাদেরকে কিয়ামতের দিনে পরিপূর্ণ জ্যোতির শুভ সংবাদ জানিয়ে দাও।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (একদা সমবেত সহচরদের উদ্দেশ্যে) বললেন, “তোমাদেরকে এমন একটি কাজ বলে দেব না কি, যার দ্বারা আল্লাহ গোনাহসমূহকে মোচন ক’রে দেবেন এবং (জান্নাতে) তার দ্বারা মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন?” তাঁরা বললেন, ‘অবশ্যই, হে আল্লাহ রসূল!’ তিনি বললেন, “(তা হচ্ছে) কষ্টকর অবস্থায় পরিপূর্ণরূপে ওযূ করা, অধিক মাত্রায় মসজিদে গমন করা এবং এক অক্তের নামায আদায় ক’রে পরবর্তী অক্তের নামাযের জন্য প্রতীক্ষা করা । আর এ হল প্রতিরক্ষা বাহিনীর মত কাজ । এ হল প্রতিরক্ষা বাহিনীর মত কাজ ।” আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কোনো ব্যক্তিকে তোমরা যখন মসজিদে যাওয়া আসায় অভ্যস্ত দেখতে পাও তখন তার ঈমানদারীর সাক্ষী দাও । কারণ মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করে কেবল তারাই যারা আল্লাহর উপর এবং শেষ দিবসের (পরকালের) উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে... ।” (সূরা আত্-তাওবাহ্ঃ ১৮) (তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন) (আমি (আলবানী) বলছিঃ তিনি এরূপই বলেছেন । কিন্তু এর সনদটি দুর্বল যেমনটি আমি “আলমিশকাত” গ্রন্থে (নং ৭২৩) বর্ণনা করেছি। তবে এর ভাবার্থ সহীহ্ । এর সনদে দার্রাজ ইবনু আবিস সাম্হ্ নামক এক বর্ণনাকারী রয়েছেন । তার সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার “আত্তাক্বরীব” গ্রন্থে বলেনঃ তিনি তার হাদীসের ব্যাপারে সত্যবাদী, তবে আবুল হাইশাম হতে তার বর্ণনা করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে । এ কারণেই হাফিয যাহাবী ইমাম হাকিমের সমালোচনা করে বলেছেনঃ দার্রাজ বহু মুনকারের অধিকারী ।
নামাযের প্রতীক্ষা করার ফযীলত
আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “নামাযের প্রতীক্ষা যতক্ষণ (কাউকে) আবদ্ধ রাখে, ততক্ষণ সে আসলে নামাযের মধ্যেই থাকে । যখন নামায ছাড়া (তাকে) তার স্বীয় পরিবারের কাছে ফিরে যেতে অন্য কোন জিনিস বাধা না দেয় ।” (অর্থাৎ নামাযের উদ্দেশ্যে যতক্ষণ বসে থাকে, পুণ্যপ্রাপ্তির দিক দিয়ে সে পরোক্ষভাবে নামাযেই প্রবৃত্ত থাকে ।) উক্ত রাবী (রাঃ) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “ফিরিশ্তাবর্গ তোমাদের প্রত্যেকের জন্য দুআ করে থাকেন, যতক্ষণ সে সেই স্থানে অবস্থান করে, যেখানে সে নামায পড়েছে; যতক্ষণ পর্যন্ত না তার ওযূ নষ্ট হয়েছে; বলেন, ‘হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা ক’রে দাও । হে আল্লাহ , ওর প্রতি সদয় হও ।” আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, এক রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এশার নামায অর্ধেক রাত পর্যন্ত পিছিয়ে দিলেন । অতঃপর নামায পড়ার পর আমাদের দিকে মুখ ক’রে বললেন, “লোকেরা নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর তোমরা নামাযেই ছিলে; যখন থেকে তার অপেক্ষায় ছিলে ।”
জামাত সহকারে নামাযের ফযীলত
ইবনে উমার (রযিয়াল্লাহু আনহুমা) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “একাকীর নামায অপেক্ষা জামাআতের নামায সাতাশ গুণ উত্তম ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “জামাতের সাথে কারো নামায পড়া, তার ঘরে ও বাজারে একা নামায পড়ার চাইতে ২৫ গুণ বেশি শ্রেষ্ ঠ। তা এই জন্য যে, যখন কোনো ব্যক্তি ওযূ করে এবং উত্তমরূপে ওযূ সম্পাদন করে। অতঃপর মসজিদ অভিমুখে যাত্রা করে । আর একমাত্র নামাযই তাকে (ঘর থেকে) বের করে (অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকে না), তখন তার (পথে চলার সময়) প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং একটি গোনাহ মাফ করা হয় । তারপর সে নামাযান্তে নামায পড়ার জায়গায় যতক্ষণ ওযূ সহকারে অবস্থান করে, ফিরিশ্তাবর্গ তার জন্য দুআ করেন; তাঁরা বলেন, ‘হে আল্লাহ ! ওর প্রতি অনুগ্রহ কর । হে আল্লাহ ! তুমি ওকে রহম কর ।’ আর সে ব্যক্তি ততক্ষণ নামাযের মধ্যেই থাকে, যতক্ষণ সে নামাযের প্রতীক্ষা করে ।” উক্ত রাবী (রাঃ) একটি অন্ধ লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আমার কোন পরিচালক নেই, যে আমাকে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে যাবে ।’ সুতরাং সে নিজ বাড়িতে নামায পড়ার জন্য আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট অনুমতি চাইল । তিনি তাকে অনুমতি দিলেন । কিন্তু যখন সে পিঠ ঘুরিয়ে রওনা দিল, তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, “তুমি কি আহ্বান (আযান) শুনতে পাও ?” সে বলল, ‘জী হ্যাঁ ।’ তিনি বললেন, “তাহলে তুমি সাড়া দাও ।” (অর্থাৎ মসজিদেই এসে নামায পড় ।) আব্দুল্লাহ (মতান্তরে) আম্র ইবনে ক্বায়স ওরফে ইবনে উম্মে মাকতূম মুআযযিন (রাঃ) একদা তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল ! মদিনায় সরীসৃপ (সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি বিষাক্ত জন্তু) ও হিংস্র পশু অনেক আছে । (তাই আমাকে নিজ বাড়িতেই নামায পড়ার অনুমতি দিন) ।’ আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ ও হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ (আযান) শুনতে পাও ? (যদি শুনতে পাও), তাহলে মসজিদে এসো ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “সেই মহান সত্তার শপথ ! যার হাতে আমার জীবন আছে । আমার ইচ্ছা হচ্ছে যে, জ্বালানী কাঠ জমা করার আদেশ দিই । তারপর নামাযের জন্য আযান দেওয়ার আদেশ দিই । তারপর কোন লোককে লোকদের ইমামতি করতে আদেশ দিই । তারপর আমি স্বয়ং সেই সব (পুরুষ) লোকদের কাছে যাই (যারা মসজিদে নামায পড়তে আসেনি) এবং তাদেরকেসহ তাদের ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিই ।” (বুখারী ও মুসলিম) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তিনি বলেন, “যাকে এ কথা আনন্দ দেয় যে, সে কাল কিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে মুসলিম হয়ে সাক্ষাৎ করবে, তার উচিত, সে যেন এই নামাযসমূহ আদায়ের প্রতি যত্ন রাখে, যেখানে তার জন্য আযান দেওয়া হয় (অর্থাৎ, মসজিদে) । কেননা, মহান আল্লাহ তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিমিত্তে হিদায়েতের পন্থা নির্ধারণ করেছেন । আর নিশ্চয় এই নামাযসমূহ হিদায়েতের অন্যতম পন্থা ও উপায় । যদি তোমরা (ফরয) নামায নিজেদের ঘরেই পড়, যেমন এই পিছিয়ে থাকা লোক নিজ ঘরে নামায পড়ে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর তরীকা পরিহার করবে । আর (মনে রেখো,) যদি তোমরা তোমাদের নবীর তরীকা পরিহার কর, তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরা পথহারা হয়ে যাবে । আমি আমাদের লোকদের এই পরিস্থিতি দেখেছি যে, নামায (জামাতসহ পড়া) থেকে কেবল সেই মুনাফিক (কপট মুসলিম) পিছিয়ে থাকে, যে প্রকাশ্য মুনাফিক । আর (দেখেছি যে, পীড়িত) ব্যক্তিকে দু’জনের উপর ভর দিয়ে নিয়ে এসে (নামাযের) সারিতে দাঁড় করানো হতো ।’ আবূ দার্দা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, “যে কোন গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাআতে) নামায কায়েম না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার ক’রে ফেলে । সুতরাং তোমরা জামাআতবদ্ধ হও । অন্যথা ছাগ পালের মধ্য হতে নেকড়ে সেই ছাগলটিকে ধরে খায়, যে (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে ।”
ফজর ও এশার জামাআতে হাযির হতে উৎসাহদান
উসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি জামাআতের সাথে এশার নামায আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত পর্যন্ত কিয়াম (ইবাদত) করল । আর যে ফজরের নামায জামাতসহ আদায় করল, সে যেন সারা রাত নামায পড়ল ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যদি লোকে এশা ও ফজরের নামাযের ফযীলত জানতে পারত, তাহলে তাদেরকে হামাগুড়ি বা পাছা ছেঁচড়ে আসতে হলেও তারা অবশ্যই ঐ নামাযদ্বয়ে আসত ।” উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “মুনাফিক (কপট)দের উপর ফজর ও এশার নামায অপেক্ষা অধিক ভারী নামায আর নেই । যদি তারা এর ফযীলত ও গুরুত্ব জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে বা পাছার ভরে অবশ্যই (মসজিদে) উপস্থিত হত ।”
ফরয নামাযসমূহের প্রতি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ এবং তা ত্যাগ করা সম্বন্ধে কঠোর নিষেধ ও চরম হুমকি
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সর্বোত্তম আমল কি ?’ তিনি বললেন, “যথা সময়ে নামায আদায় করা ।” আমি বললাম, ‘তারপর কি ?’ তিনি বললেন, “মা-বাপের সাথে সদ্ব্যবহার করা ।” আমি বললাম, ‘তারপর কি ?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর পথে জিহাদ করা ।” আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর প্রতিষ্ঠিত । (১) এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ । (২) নামায প্রতিষ্ঠা করা । (৩) যাকাত প্রদান করা । (৪) কা‘বা গৃহের হজ্জ করা । (৫) রমযান মাসে রোযা পালন করা ।” উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “লোকদের বিরুদ্ধে আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত (সশস্ত্র) সংগ্রাম চালাবার আদেশ দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য দেবে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ’ এবং নামায প্রতিষ্ঠা করবে ও যাকাত আদায় করবে । সুতরাং যখনই তারা সেসব বাস্তবায়ন করবে, তখনই তারা ইসলামী হক ব্যতিরেকে নিজেদের জান-মাল আমার নিকট হতে বাঁচিয়ে নিবে । আর তাদের (আভ্যন্তরীণ বিষয়ের) হিসাব আল্লাহর দায়িত্বে থাকবে ।” মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে ইয়ামান পাঠালেন ও বললেন, “নিশ্চয় তুমি কিতাব ধারী সম্প্রদায়ের কাছে যাত্রা করছ । সুতরাং তুমি তাদেরকে এই কথার প্রতি আহ্বান জানাবে যে, তারা সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রসূল । যদি তারা ঐ প্রস্তাব গ্রহণ ক’রে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি দিবারাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন । যদি তারা এ কথাটিও মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে অবহিত করবে যে, মহান আল্লাহ তাদের (ধনীদের) উপর যাকাত ফরয করেছেন যা তাদের ধনী ব্যক্তিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে । যদি তারা এই আদেশটিও পালন করতে সম্মত হয়, তাহলে তুমি (যাকাত আদায়ের সময়) তাদের উৎকৃষ্ট মাল-ধন হতে বিরত থাকবে এবং মজলূম (অত্যাচারিত) ব্যক্তির বদ্দুআ থেকে দূরে থাকবে । কেননা, তার ও আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না ।” জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, “মানুষ ও কুফরির মধ্যে (পর্দা) হল, নামায ত্যাগ করা ।” বুরাইদাহ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে চুক্তি আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মধ্যে বিদ্যমান, তা হচ্ছে নামায (পড়া) । অতএব যে নামায ত্যাগ করবে, সে নিশ্চয় কাফের হয়ে যাবে ।” সর্বজন মহামান্য শাক্বীক ইবনে আব্দুল্লাহ তাবেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সহচরবৃন্দ নামায ছাড়া অন্য কোনো আমল ত্যাগ করাকে কুফরীমূলক কাজ বলে মনে করতেন না ।’ আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “নিশ্চয় কিয়ামতের দিন বান্দার (হক্বুক্বুল্লাহর মধ্যে) যে কাজের হিসাব সর্বপ্রথম নেওয়া হবে তা হচ্ছে তার নামায । সুতরাং যদি তা সঠিক হয়, তাহলে সে পরিত্রাণ পাবে । আর যদি (নামায) পণ্ড ও খারাপ হয়, তাহলে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে । যদি তার ফরয (ইবাদতের) মধ্যে কিছু কম পড়ে যায়, তাহলে প্রভু বলবেন, ‘দেখ তো ! আমার বান্দার কিছু নফল (ইবাদত) আছে কি না, যা দিয়ে ফরযের ঘাটতি পূরণ করে দেওয়া হবে ?’ অতঃপর তার অবশিষ্ট সমস্ত আমলের হিসাব ঐভাবে গৃহীত হবে ।
প্রথম কাতারের ফযীলত, প্রথম কাতারসমূহ পূরণ করা, কাতার সোজা করা এবং ঘন হয়ে কাতার বাঁধার গুরুত্ব
জাবের ইবনে সামুরাহ (রাঃ) তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের নিকট এসে বললেন, “ফিরিশ্তামন্ডলী যেরূপ তাদের প্রভুর নিকট সারিবদ্ধ হন, তোমরা কি সেরূপ সারিবদ্ধ হবে না ।” আমরা নিবেদন করলাম, ‘হে আল্লাহর রসূল ! ফিরিশ্তামন্ডলী তাদের প্রভুর নিকট কিরূপ সারিবদ্ধ হন ?’ তিনি বললেন, “প্রথম সারিগুলো পূর্ণ করেন এবং সারিতে ঘন হয়ে দাঁড়ান ।” (মুসলিম) আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “লোকেরা যদি জানত যে, আযান দেওয়া ও নামাযের প্রথম সারিতে দাঁড়াবার কি মাহাত্ম্য আছে, অতঃপর (তাতে অংশগ্রহণের জন্য) যদি লটারি ছাড়া অন্য কোন উপায় না পেত, তবে তারা অবশ্যই সে ক্ষেত্রে লটারির সাহায্য নিত।” উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “পুরুষদের কাতারের মধ্যে সর্বোত্তম কাতার হল প্রথম কাতার, আর নিকৃষ্টতম কাতার হল শেষ কাতার । আর মহিলাদের সর্বোত্তম কাতার হল পিছনের (শেষ) কাতার এবং নিকৃষ্টতম কাতার হল প্রথম কাতার ।” আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বীয় সাহাবীদের মাঝে (প্রথম কাতার থেকে) পিছিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করে তাঁদেরকে বললেন, “এগিয়ে এসো, অতঃপর আমার অনুসরণ কর । আর যারা তোমাদের পরে আছে, তারা তোমাদের অনুসরণ করুক । (মনে রাখবে) লোকে সর্বদা পিছিয়ে যেতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে (তাঁর করুণাদানে) পিছনে করে দেন ।” আবূ মাসঊদ (রাঃ) তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে (কাতার বাঁধার সময়) আমাদের কাঁধে হাত বুলিয়ে বলতেন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও, তোমরা (কাতার বাঁধার সময়ে) পরস্পরের বিরোধিতা করো না; নচেৎ তোমাদের অন্তরের মধ্যে বিরোধিতা সৃষ্টি হবে । তোমাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী তারা যেন আমার নিকটবর্তী থাকে । তারপর যারা (জ্ঞান ও যোগ্যতায়) তাদের কাছাকাছি হবে (তারা দাঁড়াবে) । তারপর যারা (জ্ঞান ও যোগ্যতায়) তাদের কাছাকাছি হবে (তারা দাঁড়াবে) ।” আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (নামাযে দাঁড়িয়ে) বললেন, “তোমরা কাতার সোজা কর । কেননা, কাতার সোজা করা নামাযের পরিপূর্ণতার অংশ বিশেষ ।” (বুখারী ও মুসলিম) পূর্বোক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, একদা নামাযের তাকবীর (ইকামত) দেওয়া হল, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের দিকে মুখ ক’রে বললেন, “তোমরা কাতারসমূহ সোজা কর এবং মিলিতভাবে দাঁড়াও । কারণ, তোমাদেরকে আমার পিছন থেকেও দেখতে পাই ।” (এই শব্দে বুখারী এবং একই অর্থে মুসলিম বর্ণনা করেছেন । নু‘মান ইবনে বাশীর (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, “তোমরা নিজেদের কাতার জরুর সোজা ক’রে নাও; নচেৎ আল্লাহ তোমাদের মুখমণ্ডলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ক’রে দিবেন ।” বারা’ ইবনে আযেব (রাঃ) তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাযে কাতারের ভিতরে ঢুকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চলা ফেরা করতেন এবং আমাদের বুকে ও কাঁধে হাত দিতেন (অর্থাৎ হাত দিয়ে কাতার ঠিক করতেন) আর বলতেন, “তোমরা বিভেদ করো না (অর্থাৎ কাতার থেকে আগে পিছে হটো না ।) নচেৎ তোমাদের অন্তর রাজ্যেও বিভেদ সৃষ্টি হবে ।” তিনি আরও বলতেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ প্রথম কাতারগুলির উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফিরিশ্তাবর্গ তাদের জন্য রহমত প্রার্থনা করেন ।” আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা কাতারগুলি সোজা ক’রে নাও । পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাও । (কাতারের) ফাঁক বন্ধ ক’রে নাও । তোমাদের ভাইদের জন্য হাতের বাজু নরম ক’রে দাও । আর শয়তানের জন্য ফাঁক ছেড়ো না । (মনে রাখবে,) যে ব্যক্তি কাতার মিলাবে, আল্লাহ তার সাথে মিল রাখবেন, আর যে ব্যক্তি কাতার ছিন্ন করবে (মানে কাতারে ফাঁক রাখবে), আল্লাহও তার সাথে (সম্পর্ক) ছিন্ন করবেন ।” আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “ঘন ক’রে কাতার বাঁধ এবং কাতারগুলিকে পরস্পরের কাছাকাছি রাখ । ঘাড়সমূহ একে অপরের বরাবর কর । সেই মহান সত্তার শপথ ! যার হাতে আমার প্রাণ আছে, কাতারের মধ্যেকার ফাঁকে শয়তানকে আমি প্রবেশ করতে দেখতে পাই, যেন তা কালো ছাগলের ছানা ।” (এ হাদীসটি বিশুদ্ধ, আবূ দাঊদ মুসলিমের শর্তানুযায়ী বর্ণনা করেছেন) পূর্বোক্ত রাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (নামায প্রাক্কালে) বলেন, “তোমরা আগের কাতারটি পূর্ণ ক’রে নাও । তারপর ওর সংলগ্ন (কাতার পূর্ণ কর) । তারপর যে অসম্পূর্ণতা থাকে, তা শেষ কাতারে থাকুক ।” (আবূ দাঊদ, হাসান সূত্রে) আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ অবশ্যই কাতারগুলোর ডানদিকের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং আল্লাহর ফেরেশতারা তাদের জন্য দুআ করতে থাকেন । (আবূ দাঊদ) বারা’ (রাঃ) তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পিছনে যখন নামায পড়তাম তখন তাঁর ডান দিকে (দাঁড়ানো) পছন্দ করতাম । যাতে তিনি স্বীয় মুখমণ্ডল আমাদের দিকে ফিরান । বস্তুত: আমি (একদিন) তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘রাব্বি ক্বিনী আযা-বাকা ইয়াওমা তাবআসু (অথবা তাজমাউ) ইবা-দাক ।’ হে আমার প্রভু ! তুমি আমাকে তোমার সেই দিনের আযাব থেকে বাঁচিয়ো, যেদিন তুমি স্বীয় বান্দাদেরকে কবর থেকে উঠাবে কিংবা হিসাবের জন্য জমা করবে । আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা ইমামকে কাতারের ঠিক মাঝখানে কর । আর কাতারের ফাঁক বন্ধ করো ।”
ফরয নামাযের সাথে সুন্নাতে ‘মুআক্কাদাহ’ পড়ার ফযীলত। আর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ও তার মাঝামাঝি রাকআত-সংখ্যার বিবরণ
মু’মিন জননী উম্মে হাবীবাহ রামলা বিনতে আবূ সুফিয়ান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, “যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য প্রত্যহ ফরয নামায ছাড়া বারো রাকআত সুন্নত নামায পড়ে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ করেন অথবা তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হয় ।” আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে আমি দু’ রাকআত যোহরের (ফরযের) আগে, দু’ রাকআত তার পরে এবং দু’ রাকআত জুমআর পরে, দু’ রাকআত মাগরেব বাদ, আর দু’ রাকআত নামায এশার (ফরযের) পরে পড়েছি ।’ আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “প্রত্যেক দুই আযানের মাঝখানে নামায আছে । প্রত্যেক দুই আযানের মাঝখানে নামায আছে । প্রত্যেক দুই আযানের মাঝখানে নামায আছে ।” তৃতীয়বারে বললেন, “যে চায় তার জন্য ।”
ফজরের দু’ রাকআত সুন্নতের গুরুত্ব
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের (ফরয নামাযের) পূর্বে চার রাকআত ও ফজরের আগে দু’ রাকআত নামায কখনো ত্যাগ করতেন না । (বুখারী) উক্ত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের দু’ রাকআত সুন্নতের প্রতি যেরূপ যত্নবান ছিলেন, সেরূপ অন্য কোনো নফল নামাযের প্রতি ছিলেন না ।’ উক্ত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ফজরের দু’ রাকআত (সুন্নত) পৃথিবী ও তাতে যা কিছু আছে সবার চেয়ে উত্তম ।” আবূ আব্দুল্লাহ বিলাল ইবনে রাবাহ- (একবার) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে ফজরের নামাযের খবর দেবার মানসে তাঁর নিকট হাযির হলেন । তখন আয়েশা (রাঃ) তাঁকে এমন বিষয়ে ব্যস্ত রাখলেন, তিনি যে সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন । শেষ পর্যন্ত ভোর খুব বেশি পরিস্ফুট হয়ে পড়ল, সুতরাং বিলাল দাঁড়িয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নামাযের খবর দিলেন এবং বারংবার জানাতে থাকলেন । কিন্তু তিনি বাইরে এলেন না । (তার কিছুক্ষণ পর) তিনি এলেন ও লোকদেরকে নিয়ে নামায পড়লেন । তখন বিলাল (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জানালেন যে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁকে এমন বিষয়ে ব্যস্ত রেখেছিলেন, যে সম্পর্কে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন । শেষ পর্যন্ত খুব ফর্সা হয়ে গেল এবং তিনিও বাইরে আসতে দেরি করলেন । তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আমি ফজরের দু’ রাকআত সুন্নত পড়ছিলাম ।” বিলাল বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আপনি তো একদম সকাল ক’রে দিলেন ।’ তিনি বললেন, “তার চেয়েও বেশি সকাল হয়ে গেলেও, আমি ঐ দু’ রাকআত সুন্নত পড়তাম এবং সুন্দর ও উত্তমরূপে পড়তাম ।”
ফজরের দু’ রাকআত সুন্নত হাল্কা পড়া, তাতে কি সূরা পড়া হয় এবং তার সময় কি?
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজরের সময় আযান ও ইকামতের মাঝখানে সংক্ষিপ্ত দু’ রাকআত নামায পড়তেন । (বুখারী ও মুসলিম) হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা যখন মুআয্যিন আযান দিত ও ফজর উদয় হত তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দু’ রাকআত সংক্ষিপ্ত নামায পড়তেন । (বুখারী-মুসলিম) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রাতে (তাহাজ্জুদের নামায) দুই দুই রাকআত ক’রে পড়তেন । আর রাতের শেষ ভাগে এক রাকআত বিত্র পড়তেন । ফজরের নামাযের পূর্বে দু’ রাকআত (সুন্নত) পড়তেন । আর এত দ্রুত পড়তেন যেন তাকবীর-ধ্বনি তাঁর কানে পড়ছে ।’ (বুখারী ও মুসলিম) ইবনে আব্বাস (রাঃ) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের সুন্নত নামাযের প্রথম রাকআতে ‘ক্বূলূ আমান্না বিল্লাহি অমা উনযিলা ইলাইনা’ (১৩৬নং) শেষ আয়াত পর্যন্ত - যেটি সূরা বাক্বারায় আছে - পাঠ করতেন । আর তার দ্বিতীয় রাকআতে ‘আমান্না বিল্লাহি অশহাদ বিআন্না মুসলিমূন’ (আলে ইমরানের ৫২নং আয়াত) পড়তেন । অন্য বর্ণনায় আছে, দ্বিতীয় রাকআতে আলে-ইমরানের (৬৪নং আয়াত) ‘তাআলাউ ইলা কালিমাতিন সাওয়াইন বাইনানা অবাইনাকুম’ পাঠ করতেন । আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজরের দু’ রাকআত সুন্নতে সূরা ‘ক্বুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরূন’ ও ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ পাঠ করতেন । আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এক মাস ব্যাপী লক্ষ্য করে দেখলাম, তিনি ফজরের আগে দু’রাকআত সুন্নত নামাযে এই দুই সূরা ‘ক্বুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন’ ও ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ পাঠ করতেন ।
তাহাজ্জুদের নামায পড়ুক আর না পড়ুক ফজরের দু’ রাকআত সুন্নত পড়ে ডান পাশে শোয়া মুস্তাহাব ও তার প্রতি উৎসাহ দান ।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ফজরের দু’ রাকআত সুন্নত পড়তেন, তখন ডান পাশে শুয়ে (বিশ্রাম) নিতেন ।’ উক্ত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এশার নামায শেষ করার পর থেকে নিয়ে ফজরের নামায অবধি এগার রাকআত (তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন) । প্রত্যেক দু’ রাকআতে সালাম ফিরতেন এবং এক রাকআত বিত্র পড়তেন । অতঃপর যখন মুআযযিন ফজরের নামাযের আযান দিয়ে চুপ হত এবং ফজর তাঁর সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, আর মুআযযিন (ফজরের সময় সম্পর্কে অবহিত করার জন্য) তাঁর কাছে আসত, তখন তিনি উঠে সংক্ষিপ্তভাবে দু’ রাকআত নামায পড়ে নিতেন । তারপর ডান পার্শে শুয়ে (জিরিয়ে) নিতেন । এইভাবে মুআযযিন নামাযের তাকবীর দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে হাযির হওয়া পর্যন্ত (তিনি শুয়ে থাকতেন) ।’ আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন ফজরের দু’ রাকআত সুন্নত পড়বে, তখন সে যেন তার ডান পাশে শুয়ে যায় ।” (আবূ দাঊদ, তিরমিযী বিশুদ্ধ সূত্রে, তিরমিযীর উক্তি: হাদিসটি হাসান সহীহ)
যোহরের সুন্নত
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সঙ্গে যোহরের আগে দু’ রাকআত ও তার পরে দু’ রাকআত সুন্নত পড়েছি ।’ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের আগে চার রাকআত সুন্নত ত্যাগ করতেন না । (বুখারী) উক্ত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে যোহরের পূর্বে চার রাকআত সুন্নত পড়তেন, তারপর (মসজিদে) বের হয়ে গিয়ে লোকেদেরকে নিয়ে নামায পড়তেন । অতঃপর ঘরে প্রবেশ করতেন এবং দু’ রাকআত সুন্নত পড়তেন । তিনি লোকেদেরকে নিয়ে মাগরিবের নামায পড়ার পর আমার ঘরে প্রবেশ করতেন এবং দু’ রাক‘আত সুন্নত পড়তেন । (অনুরূপভাবে) তিনি লোকেদেরকে নিয়ে এশার নামায পড়তেন, অতঃপর আমার ঘরে ফিরে এসে দু’ রাক‘আত সুন্নত পড়তেন ।’ উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি যোহরের ফরয নামাযের পূর্বে চার রাকআত ও পরে চার রাকআত সুন্নত পড়তে যত্নবান হবে, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম ক’রে দেবেন ।” আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রাঃ) সূর্য (পশ্চিম গগনে) ঢলে যাবার পর, যোহরের ফরযের পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চার রাকআত সুন্নত নামায পড়তেন । আর বলতেন, “এটা এমন সময়, যখন আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয় । তাই আমার পছন্দ যে, সে সময়েই আমার সৎকর্ম ঊর্ধ্বে উঠুক ।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন যোহরের পূর্বে চার রাক‘আত সুন্নত পড়তে সুযোগ পেতেন না, তখন তার পরে তা পড়ে নিতেন ।
আসরের সুন্নতের বিবরণ
আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসরের ফরয নামাযের আগে চার রাকআত সুন্নত পড়তেন । তার মাঝখানে নিকটবর্তী ফিরিশ্তাবর্গ ও তাঁদের অনুসারী মুসলিম ও মু’মিনদের প্রতি সালাম পেশ করার মাধ্যমে পার্থক্য করতেন ।’ ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে ব্যক্তি আসরের পূর্বে চার রাকআত সুন্নত পড়ে ।” আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (মাঝে মাঝে) আসরের আগে দু রাক‘আত (সুন্নাত) পড়তেন । (আবূ দাঊদ) হাদিসটি যইফ । (আমি (আলবানী) বলছিঃ কিন্তু ‘তিনি আসরের পূর্বে দু’রাক‘আত আদায় করতেন’ এ ভাষায় হাদীসটি শায । নিরাপদ হচ্ছে “তিনি আসরের পূর্বে চার রাক‘আত সলাত আদায় করতেন’ ।
মাগরেবের ফরয নামাযের পূর্বে ও পরের সুন্নতের বিবরণ
আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল (রাঃ) একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (দু’বার) বললেন, “তোমরা মাগরেবের পূর্বে (দু’ রাকআত) নামায পড় ।” অতঃপর তৃতীয় বারে তিনি বললেন, “যার ইচ্ছা হবে, (সে পড়বে ।)” আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বড় বড় সাহাবীদেরকে দেখেছি, তাঁরা মাগরিবের সময় থামগুলোর দিকে দ্রুত বেগে অগ্রসর হতেন ।’ (দু’ রাকআত সুন্নত পড়ার উদ্দেশ্যে ।) উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের ফরয নামাযের আগে দু’ রাকআত সুন্নত পড়তাম ।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ দু’ রাকআত পড়তেন কি ?’ তিনি বললেন, ‘তিনি আমাদেরকে ওই দু’ রাকআত পড়তে দেখতেন, কিন্তু আমাদেরকে (তার জন্য) আদেশও করতেন না এবং তা থেকে বারণও করতেন না ।’ উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমরা মদিনাতে ছিলাম । যখন মুআয্যিন মাগরেবের আযান দিত, তখন লোকেরা থামগুলির দিকে দ্রুত অগ্রসর হত এবং দু’ রাকআত নামায পড়ত । এমনকি কোন বিদেশী অচেনা মানুষ মসজিদে এলে, অধিকাংশ লোকের ঐ দু’ রাকআত পড়া দেখে মনে করত যে, (মাগরিবের ফরয) নামায পড়া হয়ে গেছে (এবং তারা পরের সুন্নত পড়ছে) ।’
এশার আগে ও পরের সুন্নতসমূহের বিবরণ
এ বিষয়ে বিগত ইবনে উমরের (১১০৫ নং) হাদিস, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে এশার পর দু’ রাকআত সুন্নত পড়েছি’ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল কর্তৃক বর্ণিত (১১০৬নং) হাদিস, ‘প্রত্যেক দুই আযানের মধ্যবর্তী সময়ে নামায আছে ।’ উল্লিখিত হয়েছে ।
জুমুআর সুন্নত
ইবনে উমার (রাঃ)-এর পূর্বোক্ত (১১০৫নং) হাদিস গত হয়েছে । তাতে উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে জুমুআর পর দু’ রাকআত সুন্নত পড়েছেন। (বুখারী ও মুসলিম) আবূ হুরাইরা (রাঃ) আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন কোন ব্যক্তি জুমাআর নামায আদায় করবে, তখন সে যেন তারপর চার রাকআত (সুন্নত) পড়ে ।” ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমাআর পর (মসজিদ থেকে) ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন সুন্নত নামায পড়তেন না । সুতরাং নিজ বাড়িতে (এসে) দু’ রাকআত নামায পড়তেন । (মুসলিম)
নফল (ও সুন্নত নামায) ঘরে পড়া উত্তম । তা সুন্নতে মুআক্কাদাহ হোক কিংবা অন্য কিছু । সুন্নত বা নফলের জন্য, যে স্থানে ফরয নামায পড়া হয়েছে সে স্থান পরিবর্তন করা বা ফরয ও তার মধ্যে কোনো কথা দ্বারা ব্যবধান সৃষ্টি করার নির্দেশ
যায়েদ ইবনে সাবেত (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে লোক সকল ! তোমরা নিজ নিজ বাড়িতে নামায পড় । কারণ, ফরয নামায ব্যতীত পুরুষের উত্তম নামায হল, যা সে নিজ বাড়িতে পড়ে থাকে ।” ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা নিজেদের কিছু নামায তোমাদের বাড়িতে পড় এবং সে (ঘর-বাড়ি)গুলিকে কবরে পরিণত করো না ।” জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি স্বীয় (ফরয) নামায মসজিদে আদায় ক’রে নেবে, সে যেন তার কিছু নামায নিজ বাড়ির জন্যও নির্ধারিত করে । কেননা, তার নিজ ঘরে আদায়কৃত (সুন্নত) নামাযে আল্লাহ তার জন্য কল্যাণ ও বরকত প্রদান করেন ।” উমার ইবনে আত্বা নাফে‘ ইবনে জুবাইর তাঁকে নামেরের ভাগ্নে সায়েবের নিকট এমন একটি বিষয়ে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্যে পাঠালেন, যা মুয়াবিয়া (রাঃ) তাঁকে নামাযের ব্যাপারে করতে দেখেছিলেন । তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তাঁর (মুয়াবিয়া)র সাথে মাকসূরায় (মসজিদের মধ্যে বাদশাদের জন্য তৈরি বিশেষ নিরাপদ স্থান) জুমআর নামায পড়েছি । সুতরাং যখন ইমাম সালাম ফিরালেন, তখন আমি যেখানে ফরয নামায পড়ছিলাম, সেখানেই উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং (সুন্নত) নামায পড়লাম । তারপর যখন মুয়াবিয়া (রাঃ) বাড়ি প্রবেশ করলেন, তখন আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, “তুমি যা করলে তা আগামীতে আর কখনো করো না । যখন তুমি জুমআর (ফরয) নামায পড়বে, তখন তার সাথে মিলিয়ে অন্য নামায পড়ো না; যতক্ষণ না তুমি কারো সাথে কথা বল অথবা সেখান থেকে অন্যত্র সরে যাও । কেননা, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই আদেশ আমাদেরকে করেছেন যে, আমরা যেন এক নামাযকে অন্য নামাযের সাথে না মিলাই, যতক্ষণ না কোনো লোকের সাথে কথা বলে নেই, কিংবা সেখান হতে অন্যত্র সরে যাই ।”
বিত্রের প্রতি উৎসাহ দান, তা সুন্নতে মুআক্কাদাহ এবং তা পড়ার সময়
আলী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘বিত্রের নামায, ফরয নামাযের ন্যায় অপরিহার্য নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিকে প্রচলিত করেছেন (অর্থাৎ এটি সুন্নত) । তিনি বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ বিত্র (বিজোড়) সেহেতু তিনি বিত্র (বিজোড়কে) ভালবাসেন । অতএব হে কুরআনের ধারকবাহকগণ ! তোমরা বিত্র পড় ।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘রাতের প্রতিটি ভাগেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিত্র পড়েছেন; রাতের প্রথম ভাগে, এর মধ্য ভাগে ও শেষ ভাগে । তাঁর বিত্রের শেষ সময় ছিল ভোরবেলা পর্যন্ত ।’ ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা তোমাদের রাতের শেষ নামায বিত্র কর ।” আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ফজর হওয়ার পূর্বেই তোমরা বিত্র পড়ে ফেল ।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে তাঁর (তাহাজ্জুদ) নামায পড়তেন । আর তিনি (আয়েশা) তাঁর সামনে আড়াআড়ি শুয়ে থাকতে ন। অতঃপর যখন (সব নামায পড়ে) বিত্র বাকি থাকত, তখন তাঁকে তিনি জাগাতেন এবং তিনি (আয়েশা) বিত্র পড়তেন । (মুসলিম) ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ফজর হওয়ার আগে ভাগেই বিত্র পড়ে নাও ।” (আবূ দাঊদ, তিরমিযী হাসান সহীহ) জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি শেষ রাতে উঠতে না পারার আশংকা করবে, সে যেন শুরু রাতেই বিত্র পড়ে নেয় । আর যে ব্যক্তি রাতের শেষ ভাগে উঠে (ইবাদত) করার লালসা রাখে, সে যেন রাতের শেষ ভাগেই বিত্র সমাধা করে । কারণ, রাতের শেষ ভাগের নামাযে ফিরিশ্তারা হাজির হন এবং এটিই উত্তম আমল ।
চাশ্তের নামাযের ফযীলত
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু আমাকে এই তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন; (১) প্রতি মাসে তিনটি (১৩, ১৪, ১৫ তারিখে) রোযা রাখার । (২) চাশ্তের দু’ রাকআত (সুন্নত) পড়ার । (৩) এবং ঘুমাবার আগে বিত্র পড়ে নেওয়ার ।’ (বুখারী ও মুসলিম) আবূ যার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ এমন অবস্থায় সকালে উঠে যে, তার (দেহের) প্রতিটি জোড়ের সদকা দেওয়ার জন্য সে দায়বদ্ধ হয় । সুতরাং প্রত্যেক ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা সদকাস্বরূপ, প্রত্যেক ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা সদকাস্বরূপ, প্রত্যেক ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা সদকাস্বরূপ, প্রতিটি ‘আল্লাহু আকবার’ বলা সদকাস্বরূপ, সৎকাজের আদেশ দেওয়া সদকাস্বরূপ এবং মন্দকাজে বাধা দেওয়া সদকাস্বরূপ । আর এ সমস্ত কিছুর পরিবর্তে দু’ রাকআত (চাশ্তের) নামায পড়লে তা যথেষ্ট হবে ।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চাশ্তের চার রাকআত নামায পড়তেন এবং আল্লাহ যতটা চাইতেন সেই মত তিনি আরও বেশী পড়তেন ।’ (মুসলিম) উম্মে হানী ফাখেতাহ বিন্তে আবু তালেব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের বছরে আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখি যে, তিনি গোসল করছেন । যখন তিনি গোসল সম্পন্ন করলেন, তখন আট রাকআত নামায পড়লেন । আর তখন ছিল চাশ্তের সময় ।’ (বুখারী ও মুসলিম, এ শব্দগুলি মুসলিমের একটি বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার)
সূর্য উঁচুতে ওঠার পর থেকে ঢলা পর্যন্ত চাশতের নামায পড়া বিধেয় । উত্তম হল দিন উত্তপ্ত হলে এবং সূর্য আরও উঁচুতে উঠলে এ নামায পড়া
যায়দ ইবন আরক্বাম (রাঃ) একদা তিনি দেখলেন, একদল লোক চাশ্তের নামায পড়ছে । তিনি বললেন, ‘যদি ওরা জানত যে, নামায এ সময় ছাড়া অন্য সময়ে পড়া উত্তম । আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আওয়াবীন (আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী)দের নামায যখন উঁটের বাচ্চার পা বালিতে গরম অনুভব করে ।” (মুসলিম)
তাহিয়্যাতুল মাসজিদ
আবূ কাতাদাহ (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ মসজিদ প্রবেশ করবে, তখন সে যেন দু’ রাকআত নামায না পড়া অবধি না বসে ।” (বুখারী ও মুসলিম) জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এলাম, তখন তিনি মসজিদে ছিলেন । তিনি বললেন, “দু’ রাকআত নামায পড় ।” (বুখারী, মুসলিম)
ওযূর পর তাহিয়্যাতুল ওযূর দু’ রাকআত নামায পড়া উত্তম
আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিলাল (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য ক’রে বললেন, “হে বিলাল ! আমাকে সর্বাধিক আশাপ্রদ আমল বল, যা তুমি ইসলাম গ্রহণের পর বাস্তবায়িত করেছ । কেননা, আমি (মি’রাজের রাতে) জান্নাতের মধ্যে আমার সম্মুখে তোমার জুতার শব্দ শুনেছি ।” বিলাল (রাঃ) বললেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এর চাইতে বেশী আশাপ্রদ এমন কোন আমল করিনি যে, আমি যখনই রাত-দিনের মধ্যে যে কোন সময় পবিত্রতা অর্জন (ওযূ, গোসল বা তায়াম্মুম) করেছি, তখনই ততটুকু নামায পড়েছি, যতটুকু নামায পড়া আমার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ ছিল ।’
জুমআর দিনের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব
জুমআর জন্য গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, সকাল সকাল মসজিদে যাওয়া, এ দিনে দুআ করা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়া ও এ দিনের কোন এক সময়ে দুআ কবুল হওয়ার বিবরণ এবং জুমআর পর বেশী বেশী মহান আল্লাহর যিক্র করা মুস্তাহাব মহান আল্লাহ বলেছেন, অর্থাৎ অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর ও আল্লাহকে অধিকরূপে স্মরণ কর; যাতে তোমরা সফলকাম হও । (সূরা জুমআহ ১০ আয়াত) আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যার উপর সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমআর দিন । এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে বেহেশ্তে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে বেহেশ্ত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে ।” উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযূ সম্পাদন ক’রে জুমআর নামায পড়তে আসবে এবং নীরবে মনোযোগসহকারে (খুতবা) শুনবে, তার সেই জুমআহ হতে পরবর্তী জুমআর মধ্যবর্তী সময় তথা আরও তিন দিনের (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র) পাপসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে । আর যে ব্যক্তি কাঁকর স্পর্শ করবে, সে বাজে কাজ করবে ।” উক্ত রাবী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পাঁচ অক্ত নামায, এক জুমআহ হতে পরের জুমআহ পর্যন্ত, এক রমযান হতে অন্য রমযান পর্যন্ত (কৃত নামায-রোযা) সেগুলির মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র) পাপরাশির প্রায়শ্চিত্ত (মোচনকারী) হয় (এই শর্তে যে,) যখন মহাপাপ থেকে বিরত থাকা যাবে ।” আবূ হুরাইরা ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে তাঁর কাঠের মিম্বারের উপর দাঁড়ানো অবস্থায় এ কথা বলতে শুনেছেন যে, “লোকেরা যেন জুমআহ ত্যাগ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকে; নচেৎ আল্লাহ অবশ্যই তাদের অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেবেন, তারপর তারা অবশ্যই উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে ।” ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন জুমআতে আসার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন গোসল করে ।” আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “প্রত্যেক সাবালকের উপর জুমআর দিনের গোসল ওয়াজেব ।” সামুরাহ (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিনে ওযূ করল তাহলে তা যথেষ্ট ও উত্তম । আর যে গোসল করল, (তার) গোসল হল সর্বোত্তম ।” সালমান (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে কোন ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল ও সাধ্যমত পবিত্রতা অর্জন করে, নিজস্ব তেল গায়ে লাগায় অথবা নিজ ঘরের সুগন্ধি (আতর) ব্যবহার করে, অতঃপর (মসজিদে) গিয়ে দু’জনের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি না করেই (যেখানে স্থান পায়, বসে যায়) এবং তার ভাগ্যে যত রাকআত নামায জোটে, আদায় করে । তারপর ইমাম খুতবা আরম্ভ করলে নীরব থাকে, সে ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট জুমআহ থেকে পরবর্তী জুমআহ পর্যন্ত কৃত সমুদয় (সাগীরা) গুনাহরাশিকে মাফ ক’রে দেওয়া হয় ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন নাপাকির গোসলের ন্যায় গোসল করল এবং (সূর্য ঢলার সঙ্গে সঙ্গে) প্রথম অক্তে মসজিদে এল, সে যেন একটি উঁট দান করল । যে ব্যক্তি দ্বিতীয় সময়ে এলো, সে যেন একটি গাভী দান করল । যে ব্যক্তি তৃতীয় সময়ে এল, সে যেন একটি শিংবিশিষ্ট দুম্বা দান করল । যে ব্যক্তি চতুর্থ সময়ে এল, সে যেন একটি মুরগী দান করল । আর যে ব্যক্তি পঞ্চম সময়ে এল, সে যেন একটি ডিম দান করল । তারপর ইমাম যখন খুত্বাহ প্রদানের জন্য বের হন, তখন (লেখক) ফিরিশ্তাগণ যিক্র শোনার জন্য হাজির হয়ে যান ।” উক্ত রাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদা জুমআর দিন সম্বন্ধে আলোচনা ক’রে বললেন, “ওতে এমন একটি মুহূর্ত আছে, কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি ঐ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নামায অবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে তা দান ক’রে থাকেন ।” এ কথা বলে তিনি স্বীয় হাত দ্বারা ইঙ্গিত করলেন, সে মুহূর্তটি খুবই সংক্ষিপ্ত । আবূ বুর্দাহ ইবনে আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) তিনি বলেন, একদা আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কি জুমআর দিনের বিশেষ মুহূর্ত সম্পর্কে আপনার পিতাকে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণনা করতে শুনেছেন ?’ তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হ্যাঁ । আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, “সেই মুহূর্তটুকু ইমামের মেম্বারে বসা থেকে নিয়ে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ের ভিতরে ।” আওস ইবনে আওস (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম একটি দিন হচ্ছে জুমআর দিন । সুতরাং ঐ দিনে তোমরা আমার উপর বেশী বেশী দরূদ পাঠ কর । কেননা, তোমাদের পাঠ করা দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয় ।”
শুক্রের সিজদার বিবরণ
সাদ ইবনু আবী ওয়ক্কাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে আমরা মক্কা থেকে মদিনার পানে রওয়ানা দিলাম । আমরা যখন ‘আযওয়ারা নামক স্থানের নিকটবর্তী হলাম, তিনি সওয়ারী থেকে নেমে পড়লেন এবং তাঁর দুই হাত তুলে কিছুক্ষণ দুআ করলেন, তারপর সাজদাহ করলেন, দীর্ঘ সময় সাজদায় থাকলেন, তারপর উঠলেন এবং আবার দুই হাত তুলে কিছু সময় দুআ করলেন, তারপর আবার সাজদায় নত হলেন । তিনি তিনবার এমন করলেন এবং বললেন: আমি আমার প্রভুর নিকট আবেদন করেছিলাম এবং আমার উম্মতের জন্য সুপারিশ করেছিলাম । আল্লাহ আমাকে আমার এক-তৃতীয়াংশ উম্মত (জান্নাতে) দিয়েছেন । আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য আমি সাজদাহ করলাম । তারপর আমি মাথা উঠিয়ে আমার উম্মতের জন্য আমার প্রভুর কাছে আবেদন করলাম । তিনি আমাকে আমার আরও এক-তৃতীয়াংশ উম্মত (জান্নাতে) দিলেন । এজন্যও আমি কৃতজ্ঞতার সাজদাহ করলাম । তারপর মাথা তুলে আমার উম্মতের জন্য আবেদন করলাম । তিনি আমাকে আরও এক-তৃতীয়াংশ উম্মত (জান্নাতে) দিলেন । এজন্যও আমি কৃতজ্ঞতার সাজদাহ করলাম । (আমি (আলবানী) বলছিঃ হাদীসটির সনদ দুর্বল যেমনটি আমি “ইরওয়াউল গালীল” গ্রন্থে (নং ৪৬৭) এবং “য‘ঈফা” গ্রন্থে নং (৩২২৯/৩২৩০) আলোচনা করেছি । এর এক বর্ণনাকারী ইয়াহ্ইয়া ইবনুল হাসান সম্পর্কে হাফিয যাহাবী বলেনঃ তিনি মাদানী তার অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় না । তার থেকে মূসা ইবনু ইয়াকূব বর্ণনা করেছেন । এর সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ তিনি মাজহূলুল হাল । প্রকৃতপক্ষে আস‘আস ইবনু ইসহাক মাজহূলুল হাল আর মূসা ইবনু ইয়াকূব হচ্ছেন মাজহূলুল আইন । (বিস্তারিত দেখুন “য‘ঈফা” গ্রন্থের উক্ত নম্বরে) । আবূ দাঊদ ২৭৭৫ ।) (অবশ্য শুক্রের সিজদাহ অন্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত । মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কোন সুসংবাদ দেওয়া হলে তিনি সিজদাহ করতেন ।)
রাতে উঠে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়ার ফযীলত
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাত্রির একাংশে (নামাযে) এত দীর্ঘক্ষণ কিয়াম করতেন যে, তাঁর পা ফুলে ফাটার উপক্রম হয়ে পড়ত । একদা আমি তাঁকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল ! আপনি এত কষ্ট সহ্য করছেন কেন ? অথচ আপনার তো পূর্ব ও পরের গুনাহসমূহকে ক্ষমা ক’রে দেওয়া হয়েছে ।’ তিনি বললেন, “আমি কি শুকরগুযার বান্দা হব না ?” মুগীরা ইবনে শু‘বা অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে আলী (রাঃ) একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ও ফাতেমার নিকট রাত্রি বেলায় আগমন করলেন এবং বললেন, “তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) কি (তাহাজ্জুদের) নামায পড় না ?” সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (একবার) বললেন, “আব্দুল্লাহ ইবনে উমার কতই না ভাল মানুষ হত, যদি সে রাতে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়ত ।” সালেম বলেন, ‘তারপর থেকে (আমার আব্বা) আব্দুল্লাহ রাতে অল্পক্ষণই ঘুমাতেন ।’ আব্দুল্লাহ ইবনে আম্র ইবনে আস (রাঃ) তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “হে আব্দুল্লাহ ! তুমি অমুক ব্যক্তির মত হয়ো না । সে রাতে উঠে নামায পড়ত, তারপর রাতে উঠা ছেড়ে দিল ।” (বুখারী ও মুসলিম) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তিনি বলেন, এমন একটি লোকের কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উল্লেখ করা হল, যে সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে রাত্রি যাপন করে । তিনি বললেন, “এ এমন এক মানুষ, যার দু’কানে শয়তান প্রস্রাব ক’রে দিয়েছে ।” অথবা বললেন, “যার কানে প্রস্রাব করে দিয়েছে ।” (বুখারী ও মুসলিম) আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ নিদ্রা যায় তখন তার গ্রীবাদেশে শয়তান তিনটি করে গাঁট বেঁধে দেয়; প্রত্যেক গাঁটে সে এই বলে মন্ত্র পড়ে যে, ‘তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি ঘুমাও ।’ অতঃপর যদি সে জেগে উঠে আল্লাহর যিক্র করে, তাহলে একটি গাঁট খুলে যায় । তারপর যদি ওযূ করে, তবে তার আর একটি গাঁট খুলে যায় । তারপর যদি নামায পড়ে, তাহলে সমস্ত গাঁট খুলে যায় । আর তার প্রভাত হয় স্ফূর্তিভরা ভালো মনে । নচেৎ সে সকালে ওঠে কলুষিত মনে ও অলসতা নিয়ে ।” আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে লোক সকল ! তোমরা ব্যাপকভাবে সালাম প্রচার কর, (ক্ষুধার্তকে) অন্ন দাও এবং লোকে যখন রাতে ঘুমিয়ে থাকবে তখন নামায পড় । তাহলে তোমরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করবে ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “রমযান মাসের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররামের রোযা । আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হচ্ছে রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায ।” আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “রাতের নামায দু’ দু’ রাকআত করে । অতঃপর যখন ফজর হওয়ার আশংকা করবে, তখন এক রাকআত বিত্র পড়ে নেবে ।” (বুখারী ও মুসলিম) উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রাতের বেলায় দু’ দু’ রাকআত করে নামায পড়তেন এবং এক রাকআত বিত্র পড়তেন ।’ (বুখারী ও মুসলিম) আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘কোন কোন মাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমনভাবে রোযা ত্যাগ করতেন যে, মনে হত তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত মাসে আর রোযাই রাখবেন না । অনুরূপভাবে কোন মাসে এমনভাবে (একাদিক্রমে) রোযা রাখতেন যে, মনে হত তিনি ঐ মাসে আর রোযা ত্যাগই করবেন না । (তাঁর অবস্থা এরূপ ছিল যে,) যদি তুমি তাঁকে রাত্রিতে নামায পড়া অবস্থায় দেখতে না চাইতে, তবু বাস্তবে তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় দেখতে পেতে । আর তুমি যদি চাইতে যে, তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখবে না, কিন্তু বাস্তবে তুমি তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেতে ।’ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এগার রাকআত নামায পড়তেন, অর্থাৎ রাতে । তিনি মাথা তোলার পূর্বে এত দীর্ঘ সাজদাহ করতেন যে, ততক্ষণে তোমাদের কেউ পঞ্চাশ আয়াত পড়তে পারবে । আর ফরয নামাযের পূর্বে দু’ রাকআত সুন্নত নামায পড়ে ডান পাশে শুয়ে আরাম করতেন । শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকট নামাযের ঘোষণাকারী এসে হাযির হত ।’ (বুখারী) উক্ত রাবী রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রমযান ও অন্যান্য মাসে (তাহাজ্জুদ তথা তারাবীহ) ১১ রাকআতের বেশী পড়তেন না । প্রথমে চার রাকআত পড়তেন । সুতরাং তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে প্রশ্নই করো না । তারপর (আবার) চার রাকআত পড়তেন । সুতরাং তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে প্রশ্নই করো না । অতঃপর তিন রাকআত (বিত্র) পড়তেন । (একদা তিনি বিত্র পড়ার আগেই শুয়ে গেলেন ।) আমি বললাম, “হে আল্লাহর রসূল ! আপনি কি বিত্র পড়ার পূর্বেই ঘুমাবেন ?” তিনি বললেন, “আয়েশা ! আমার চক্ষুদ্বয় ঘুমায়; কিন্তু অন্তর জেগে থাকে ।” (বুখারী ও মুসলিম) উক্ত রাবী রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের প্রথম দিকে ঘুমাতেন ও শেষের দিকে উঠে নামায পড়তেন । ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে এক রাতে নামায পড়েছি । তিনি এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলেন যে, শেষ পর্যন্ত আমি একটা মন্দ কাজের ইচ্ছা করে ফেলেছিলাম ।’ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘সে ইচ্ছাটা কি করেছিলেন ?’ তিনি বললেন, ‘আমার ইচ্ছা হয়েছিল যে, তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ি ।’ হুযাইফা (রাঃ) তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে এক রাতে নামায পড়লাম । তিনি সূরা বাকারাহ আরম্ভ করলেন । আমি (মনে মনে) বললাম, ‘একশত আয়াতের মাথায় তিনি রুকু করবেন ।’ (কিন্তু) তিনি তারপরও কিরাআত চালু রাখলেন । আমি (মনে মনে) বললাম, ‘তিনি এরই দ্বারা (সূরা শেষ করে) রুকু করবেন ।’ কিন্তু তিনি সূরা নিসা পড়তে আরম্ভ করলেন এবং সম্পূর্ণ পড়লেন । তিনি স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন । যখন এমন আয়াত আসত, যাতে তাসবীহ পাঠ করার উল্লেখ আছে, তখন (আল্লাহর) তাসবীহ পাঠ করতেন । যখন কোন প্রার্থনা সম্বলিত আয়াত অতিক্রম করতেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন । যখন কোন আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত অতিক্রম করতেন, তখন তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন । (অতঃপর) তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকু করলেন । সুতরাং তিনি রুকুতে ‘সুবহানা রাবিবয়াল আযীম’ পড়তে আরম্ভ করলেন । আর তাঁর রুকু ও কিয়াম (দাঁড়িয়ে কিরাআত পড়া অবস্থা) এক সমান ছিল । তারপর তিনি রুকু থেকে মাথা তুলে ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ, রাববানা অলাকাল হাম্দ’ (অর্থাৎ আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রশংসা শুনলেন, যে তা তাঁর জন্য করল । হে আমাদের পালনকর্তা তোমার সমস্ত প্রশংসা) পড়লেন । অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ (কওমায়) দাঁড়িয়ে থাকলেন রুকুর কাছাকাছি সময় জুড়ে । তারপর সাজদাহ করলেন এবং তাতে তিনি পড়লেন, ‘সুবহানাল্লা রাবিবয়াল আ‘লা’ (অর্থাৎ আমার মহান প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি) । আর তাঁর সাজদা দীর্ঘ ছিল তার কিয়াম (দাঁড়িয়ে কিরাআত পড়া অবস্থা)র কাছাকাছি । জাবের (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সর্বোত্তম নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি বললেন, “দীর্ঘ কিয়ামযুক্ত নামায ।” আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনে আ-স (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম নামায, দাঊদ عليه السلام -এর নামায এবং আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম রোযা, দাঊদ عليه السلام -এর রোযা; তিনি অর্ধরাত নিদ্রা যেতেন এবং রাতের তৃতীয় ভাগে ইবাদত করার জন্য উঠতেন । অতঃপর রাতের ষষ্ঠাংশে আবার নিদ্রা যেতেন । জাবের (রাঃ) তিনি বললেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, “রাত্রিকালে এমন একটি সময় আছে, কোন মুসলিম ব্যক্তি তা পেয়েই দুনিয়া ও আখিরাত বিষয়ক যে কোন উত্তম জিনিস প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাকে তা দিয়ে থাকেন । ঐ সময়টি প্রত্যেক রাতে থাকে ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ রাতে নামায পড়ার জন্য উঠবে, সে যেন হাল্কাভাবে দু’ রাকআত পড়ার মাধ্যমে নামায শুরু করে ।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন রাতে (তাহাজ্জুদের) জন্য উঠতেন, তখন দু’ রাকআত সংক্ষিপ্ত নামায পড়ার মাধ্যমে আরম্ভ করতেন ।’ উক্ত রাবী রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, ‘দৈহিক ব্যথা-বেদনা বা অন্য কোন অসুবিধার কারণে যদি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর রাতের নামায ছুটে যেত, তাহলে তিনি দিনের বেলায় ১২ রাকআত নামায পড়তেন ।” উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি স্বীয় অযীফা (দৈনিক যথা নিয়মে তাহাজ্জুদের নামায) অথবা তার কিছু অংশ না পড়ে ঘুমিয়ে পড়ে, অতঃপর যদি সে ফজর ও যোহরের মধ্যবর্তী সময়ে তা পড়ে নেয়, তাহলে তার জন্য তা এমনভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়, যেন সে তা রাতেই পড়েছে ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি দয়া করুন, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং নিজ স্ত্রীকেও জাগায় । অতঃপর যদি সে (জাগতে) অস্বীকার করে, তাহলে তার মুখে পানির ছিটা মারে । অনুরূপ আল্লাহ সেই মহিলার প্রতি দয়া করুন, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং নিজ স্বামীকেও জাগায় । অতঃপর যদি সে (জাগতে) অস্বীকার করে, তাহলে সে তার মুখে পানির ছিটা মারে ।” উক্ত রাবী (রাঃ) ও আবূ সাঈদ (রাঃ) তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখন কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে রাতে জাগিয়ে উভয়ে নামায পড়ে অথবা তারা উভয়ে দু’ রাকআত করে নামায আদায় করে, তবে তাদেরকে (অতীব) যিক্রকারী ও যিক্রকারিনীদের দলে লিপিবদ্ধ করা হয় । আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ নামাযের মধ্যে তন্দ্রাভিভূত হবে, তখন সে যেন নিদ্রা যায়, যতক্ষণ না তার নিদ্রার চাপ দূর হয়ে যায় । কারণ, যখন কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে নামায পড়বে, তখন সে খুব সম্ভবত: ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে নিজেকে গালি দিতে লাগবে ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ রাতে উঠবে ও (ঘুমের চাপের কারণে) জিহ্বায় কুরআন পড়তে এমন অসুবিধা বোধ করবে যে, সে কি বলছে তা বুঝতে পারবে না, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে।”
কিয়ামে রমযান বা তারাবীহর নামায মুস্তাহাব
আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও নেকীর আশায় রমযান মাসে কিয়াম করবে (তারাবীহ পড়বে), তার পূর্বেকার পাপসমূহ মাফ ক’রে দেওয়া হবে ।” উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিয়ামে রমযান (তারাবীহ) সম্পর্কে দৃঢ় আদেশ (ওয়াজিব) না করেই, তার প্রতি উৎসাহ দান করতেন এবং বলতেন, “যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে নেকীর আশায় রমযানে কিয়াম (তারাবীহর নামায আদায়) করবে, তার অতীতের পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে ।”
শবেক্বদরের ফযীলত এবং সর্বাধিক সম্ভাবনাময় রাত্রি প্রসঙ্গে
আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি শবেক্বদরে (ভাগ্যরজনী অথবা মহীয়সী রজনীতে) ঈমানসহ নেকীর আশায় কিয়াম করে (নামায পড়ে), তার অতীতের গুনাহ মাফ ক’রে দেওয়া হয় ।” আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কিছু সাহাবাকে স্বপ্নযোগে (রমযান মাসের) শেষ সাত রাতের মধ্যে শবেক্বদর দেখানো হল । আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি দেখছি যে, শেষ সাত রাতের ব্যাপারে তোমাদের স্বপ্নগুলি পরস্পরের মুতাবিক । সুতরাং যে ব্যক্তি শবেক্বদর অনুসন্ধানী হবে, সে যেন শেষ সাত রাতে তা অনুসন্ধান করে ।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ করতেন এবং বলতেন, “তোমরা রমযানের শেষ দশকে শবেক্বদর অনুসন্ধান কর ।” উক্ত রাবী (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “রমযান মাসের শেষ দশকের বিজোড় (রাত) গুলিতে শবেক্বদর অনুসন্ধান কর।” উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘যখন রমযানের শেষ দশক প্রবেশ করত, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে নিজে জাগতেন, নিজ পরিজনদেরকেও জাগাতেন, কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং কোমরে লুঙ্গি বেঁধে নিতেন।’ উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (আল্লাহর ইবাদতের জন্য) যত পরিশ্রম করতেন, অন্য কোন মাসে তেমন পরিশ্রম করতেন না। (অনুরূপভাবে) রমযানের শেষ দশকে যত মেহনত করতেন অন্য দিনগুলিতে তত মেহনত করতেন না।’ (মুসলিম, প্রথমাংশ মুসলিম শরীফে নেই। হয়তো বা অন্য কপিতে আছে।) উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, একদা আমি নিবেদন করলাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি বলুন, যদি আমি (ভাগ্যক্রমে) শবেক্বদর জেনে নিই, তাহলে তাতে কোন্ (দুআ) পড়ব?’ তিনি বললেন, এই দুআ, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা 'আফুউউন তুহিব্বুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী।” অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা ভালবাসো। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
দাঁতন করার মাহাত্ম্য ও প্রকৃতিগত আচরণসমূহ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যদি আমি আমার উম্মতের উপর বা লোকদের উপর কঠিন মনে না করতাম, তাহলে প্রতিটি নামাযের সাথে দাঁতন করার আদেশ দিতাম।” হুযাইফা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ঘুম থেকে উঠতেন, তখন তিনি দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে নিতেন।’ আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য দাঁতন ও ওযূর পানি প্রস্তুত করে রাখতাম। অতঃপর আল্লাহর যখন রাতে তাঁকে জাগাবার ইচ্ছা হত, তখন তিনি জেগে উঠতেন। সুতরাং দাঁতন করতেন এবং ওযূ করে নামায পড়তেন।’ আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদেরকে দাঁতন করার জন্য বেশি তাকীদ করেছি।’ শুরাইহ ইবনে হানি (রাঃ) তিনি বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ বাড়িতে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম কী কাজ করতেন?’ তিনি বললেন, ‘দাঁতন করতেন।’ আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) তিনি বলেন, ‘একদা আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট প্রবেশ করলাম, তখন দাঁতনের একটি দিক তাঁর জিভের উপর রাখা ছিল।’ আয়েশা (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “দাঁতন মুখ পবিত্র রাখার ও প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের উপকরণ।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রকৃতিগত আচরণ (নবীগণের তরীকা) পাঁচটি অথবা পাঁচটি কাজ প্রকৃতিগত আচরণ, (১) খাত্না (লিঙ্গত্বক ছেদন) করা। (২) লজ্জাস্থানের লোম কেটে পরিষ্কার করা। (৩) নখ কাটা। (৪) বগলের লোম ছিঁড়া। (৫) গোঁফ ছেঁটে ফেলা।” আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “দশটি কাজ প্রকৃতিগত আচরণ; (১) গোঁফ ছেঁটে ফেলা। (২) দাড়ি বাড়ানো। (৩) দাঁতন করা। (৪) নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করা। (৫) নখ কাটা। (৬) আঙ্গুলের জোড়সমূহ ধোয়া। (৭) বগলের লোম তুলে ফেলা। (৮) গুপ্তাঙ্গের লোম পরিষ্কার করা। (৯) পানি দ্বারা ইস্তেঞ্জা (শৌচকর্ম) করা।” বর্ণনাকারী বলেন, ১০নং আচরণটি ভুলে গেছি, তবে মনে হয়, তা কুল্লি করা হবে। বর্ণনাকারী অকী' বলেন, ‘ইন্তিকাসুল মা’ মানে পানি দিয়ে ইস্তেঞ্জা করা। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা গোঁফ কেটে ফেল এবং দাড়ি লম্বা কর।”
যাকাতের অপরিহার্যতা এবং তার ফযীলত
ইবনে উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “পাঁচটি ভিত্তির উপর দ্বীনে ইসলাম স্থাপিত। (১) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রসূল। (২) নামায প্রতিষ্ঠা করা। (৩) যাকাত আদায় করা। (৪) বায়তুল্লাহর (কা‘বা গৃহে)র হজ্জ করা। এবং (৫) রমযানের রোযা পালন করা।” ত্বালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রাঃ) তিনি বলেন নাজ্দ (রিয়ায এলাকার) অধিবাসীদের একজন আলুলায়িত কেশী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত হল। আমরা তার ভন্ভন্ শব্দ শুনছিলাম, আর তার কথাও বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসল এবং (তখন বুঝলাম,) সে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করছে। (উত্তরে) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “(ইসলাম হল,) দিবা-রাত্রিতে পাঁচ ওয়াক্তের নামায (প্রতিষ্ঠা করা)।” সে বলল, ‘তা ছাড়া আমার উপর অন্য নামায আছে কি?’ তিনি বললেন, “না, কিন্তু যা কিছু তুমি নফল হিসাবে পড়বে।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার বললেন, “এবং রমযান মাসের রোযা।” লোকটি বলল, ‘তা ছাড়া আমার উপর অন্য রোযা আছে কি?’ তিনি বললেন, “না, তবে তুমি যা নফল হিসাবে করবে।” বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে যাকাতের কথা বললেন। সে বলল, ‘তাছাড়া আমার উপর অন্য দান আছে কি?’ তিনি বললেন, “না, তবে তুমি যা নফল হিসাবে করবে।” তারপর লোকটি পিঠ ফিরিয়ে এ কথা বলতে বলতে যেতে লাগল, ‘আল্লাহর কসম! আমি এর চাইতে বেশী কিছু করব না এবং এর চেয়ে কমও করব না।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “লোকটি সত্য বলে থাকলে পরিত্রাণ পেয়ে গেল।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামান পাঠাবার সময়ে (তাঁর উদ্দেশ্যে) বললেন, “তাদের (ইয়ামানবাসীদেরকে সর্বপ্রথম) এই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই, আর আমি আল্লাহর রসূল। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের উপর রাতদিনে পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করেছেন। অতঃপর যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন; যা তাদের মধ্যে যারা (নিসাব পরিমাণ) মালের অধিকারী তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের দরিদ্র ও অভাবী মানুষদের মাঝে তা বণ্টন করে দেওয়া হবে।” ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মানুষের বিরুদ্ধে ততক্ষণ সংগ্রাম করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা এই সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল। আর নামায কায়েম করবে ও (ধনের) যাকাত আদায় করবে। যখন তারা এগুলি বাস্তবায়ন করবে, তখন ইসলামী হক (অর্থদণ্ড ইত্যাদি) ছাড়া তারা নিজেদের জান-মাল আমার নিকট হতে সুরক্ষিত করে নেবে। আর (অন্তরের গভীরে কুফরি বা পাপ লুকানো থাকলে) তাদের হিসাব আল্লাহর জিম্মায়।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, যখন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেলেন এবং আবূ বাকার (রাঃ) খলীফা নিযুক্ত হলেন। আর আরববাসীদের মধ্যে যার কাফের (মুরতাদ) হবার ছিল সে কাফের (মুরতাদ) হয়ে গেল, (এবং যারা সম্পূর্ণ ধর্মত্যাগ করেনি; বরং যাকাত দিতে অস্বীকার করছে মাত্র, তাদের বিরুদ্ধে আবূ বাক্র (রাঃ) সশস্ত্র সংগ্রামের সংকল্প প্রকাশ করলেন) তখন উমার (রাঃ) বললেন, ‘ঐ (যাকাত দিতে নারাজ) লোকদের বিরুদ্ধে কেমন করে যুদ্ধ করবেন অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “লোকেরা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই) না বলা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। অতএব যে ব্যক্তি তা বলবে, সে ইসলামী অধিকার (অর্থদণ্ড ইত্যাদি) ছাড়া তার জান-মাল আমার নিকট থেকে নিরাপদ করে নেবে। আর তার (অন্তরের গভীরে কুফ্রি বা পাপ লুকানো থাকলে) হিসাব আল্লাহর যিম্মায়”? আবূ বাক্র (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, তার বিরুদ্ধে আমি লড়াই করব। কারণ, যাকাত মালের উপর আরোপিত হক। আল্লাহর শপথ! আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যে রশি আদায় করত, তা যদি আমাকে না দেয়, তাহলে তা না দেওয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আমি জিহাদ করবই।’ উমার (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! অচিরেই আমি দেখলাম যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ আবূ বাক্র (রাঃ)-এর হৃদয়কে যুদ্ধের জন্য প্রশস্ত করেছেন। সুতরাং আমি বুঝতে পারলাম যে, তাঁর সিদ্ধান্তই যথার্থ।’ আবূ আইয়ুব (রাঃ) একটি লোক নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলল, ‘আমাকে এমন একটি আমল বলুন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।’ তিনি বললেন, “আল্লাহর বন্দেগী করবে, আর তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার স্থির করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখবে।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) এক বেদুঈন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এমন এক আমলের কথা বলে দিন, যার উপর আমল করলে, আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব।’ তিনি বললেন, “আল্লাহর ইবাদত করবে ও তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার স্থির করবে না। নামায কায়েম করবে, ফরয যাকাত আদায় করবে ও রমযানের রোযা পালন করবে।” সে বলল, ‘সেই মহান সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন আছে, আমি এর চেয়ে বেশী করব না।’ তারপর যখন সে লোকটা পিঠ ফিরে চলতে লাগল, তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “যে ব্যক্তি জান্নাতবাসীদের কোন লোক দেখতে আগ্রহী, সে যেন এই লোকটিকে দেখে।” জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) তিনি বলেন, ‘নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাতে নামায কায়েম করার, যাকাত আদায় করার ও প্রতিটি মুসলমানের মঙ্গল কামনা করার বায়আত করেছি।’ আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রত্যেক সোনা ও চাঁদির অধিকারী ব্যক্তি যে তার হক (যাকাত) আদায় করে না, যখন কিয়ামতের দিন আসবে, তখন তার জন্য ঐ সমুদয় সোনা-চাঁদিকে আগুনে দিয়ে বহু পাত তৈরি করা হবে। অতঃপর সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে দাগা হবে। যখনই সে পাত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তখনই তা পুনরায় গরম করে অনুরূপ দাগার শাস্তি সেই দিনে চলতেই থাকবে, যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান; যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দাদের মাঝে বিচার-নিষ্পত্তি শেষ করা হয়েছে। অতঃপর সে তার পথ দেখতে পাবে; হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আর উটের ব্যাপারে কি হবে?’ তিনি বললেন, “প্রত্যেক উটের মালিকও; যে তার হক (যাকাত) আদায় করবে না---আর তার অন্যতম হক এই যে, পানি পান করাবার দিন তাকে দোহন করা (এবং সে দুধ লোকদের দান করা)- যখন কিয়ামতের দিন আসবে, তখন তাকে এক সমতল প্রশস্ত প্রান্তরে উপুড় করে ফেলা হবে। আর তার উট সকল পূর্ণ সংখ্যায় উপস্থিত হবে; ওদের মধ্যে একটি বাচ্চাকেও অনুপস্থিত দেখবে না। অতঃপর সেই উটদল তাদের খুর দ্বারা তাকে দলবে এবং মুখ দ্বারা তাকে কামড়াতে থাকবে। এইভাবে যখনই তাদের শেষ দল তাকে দলে অতিক্রম করে যাবে, তখনই পুনরায় প্রথম দলটি উপস্থিত হবে। তার এই শাস্তি সেদিন হবে, যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান; যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দাদের মাঝে বিচার-নিষ্পত্তি শেষ করা হয়েছে। অতঃপর সে তার শেষ পরিণাম দর্শন করবে; জান্নাতের অথবা জাহান্নামের।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! গরু-ছাগলের ব্যাপারে কি হবে?’ তিনি বললেন, “আর প্রত্যেক গরু-ছাগলের মালিককেও; যে তার হক আদায় করবে না, যখন কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে, তখন তাদের সামনে তাকে এক সমতল প্রশস্ত ময়দানে উপুড় করে ফেলা হবে; যাদের একটিকেও সে অনুপস্থিত দেখবে না এবং তাদের কেউই শিং-বাঁকা, শিং-বিহীন ও শিং-ভাঙ্গা থাকবে না। প্রত্যেকেই তার শিং দ্বারা তাকে আঘাত করতে থাকবে এবং খুর দ্বারা দলতে থাকবে। তাদের শেষ দলটি যখনই (ঢুস মেরে ও দলে) পার হয়ে যাবে তখনই প্রথম দলটি পুনরায় এসে উপস্থিত হবে। এই শাস্তি সেদিন হবে যার পরিমাণ ৫০ হাজার বছরের সমান; যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দাদের মাঝে বিচার-নিষ্পত্তি শেষ করা হয়েছে। অতঃপর সে তার রাস্তা ধরবে; জান্নাতের দিকে, নতুবা জাহান্নামের দিকে।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আর ঘোড়া সম্পর্কে কি হবে?’ তিনি বললেন, “ঘোড়া হল তিন প্রকারের; ঘোড়া কারো পক্ষে পাপের বোঝা, কারো পক্ষে পর্দাস্বরূপ এবং কারো জন্য সওয়াবের বিষয়। যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে পাপের বোঝা তা হল সেই ব্যক্তির ঘোড়া, যে লোক প্রদর্শন, গর্বপ্রকাশ এবং মুসলিমদের প্রতি শত্রুতার উদ্দেশ্যে পালন করেছে। এ ঘোড়া হল তার মালিকের জন্য পাপের বোঝা। যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে পর্দাস্বরূপ, তা হল সেই ব্যক্তির ঘোড়া, যাকে সে আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদের জন্য) প্রস্তুত রেখেছে। অতঃপর সে তার পিঠ ও গর্দানে আল্লাহর হক ভুলে যায়নি। তার যথার্থ প্রতিপালন করে জিহাদ করেছে। এ ঘোড়া হল তার মালিকের পক্ষে (দোযখ হতে অথবা ইজ্জত-সম্মানের জন্য) পর্দাস্বরূপ। আর যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য সওয়াবের বিষয়, তা হল সেই ঘোড়া যাকে তার মালিক মুসলিমদের (প্রতিরক্ষার) উদ্দেশ্যে কোন চারণভূমি বা বাগানে প্রস্তুত রেখেছে। তখন সে ঘোড়া ঐ চারণভূমি বা বাগানের যা কিছু খাবে, তার খাওয়া ঐ (ঘাস-পাতা) পরিমাণ সওয়াব মালিকের জন্য লিপিবদ্ধ হবে। অনুরূপ লেখা হবে তার লাদ ও পেশাব পরিমাণ সওয়াব। সে ঘোড়া যখনই তার রশি ছিড়ে একটি অথবা দু’টি ময়দান অতিক্রম করবে, তখনই তার পদক্ষেপ ও লাদ পরিমাণ সওয়াব তার মালিকের জন্য লিখিত হবে। অনুরূপ তার মালিক যদি তাকে কোন নদীর কিনারায় নিয়ে যায়, অতঃপর সে সেই নদী হতে পানি পান করে অথচ মালিকের পান করানোর ইচ্ছা থাকে না, তবুও আল্লাহ তা‘আলা তার পান করা পানির সমপরিমাণ সওয়াব মালিকের জন্য লিপিবদ্ধ করে দেবেন।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আর গাধা সম্পর্কে কি হবে?’ তিনি বললেন, “গাধার ব্যাপারে এই ব্যাপকার্থক একক আয়াতটি ছাড়া আমার উপর অন্য কিছু অবতীর্ণ হয়নি, অর্থাৎ, যে ব্যক্তি অণুপরিমাণ সৎকর্ম করবে সে তাও (কিয়ামতে) প্রত্যক্ষ করবে এবং যে ব্যক্তি অণু-পরিমাণ অসৎকার্য করবে সে তাও (সেদিন) প্রত্যক্ষ করবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮ আয়াত)
রমযানের রোযা ফরয, তার ফযীলত ও আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়াবলী
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মহান আল্লাহ বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকর্ম তার জন্যই; কিন্তু রোযা স্বতন্ত্র, তা আমারই জন্য, আর আমিই তার প্রতিদান দেব।’ রোযা ঢাল স্বরূপ অতএব তোমাদের কেউ যেন রোযার দিনে অশ্লীল না বলে এবং হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ তাকে গালি-গালাজ করে অথবা তার সাথে লড়াই-ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, ‘আমি রোযা রেখেছি।’ সেই মহান সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন আছে, নিঃসন্দেহে রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মৃগনাভির সুগন্ধ অপেক্ষা বেশী উৎকৃষ্ট। রোজাদারের জন্য দু’টি আনন্দময় মুহূর্ত রয়েছে, তখন সে আনন্দিত হয়; (১) যখন সে ইফতার করে (ইফতারের জন্য সে আনন্দিত হয়)। আর (২) যখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, স্বীয় রোযার জন্য সে আনন্দিত হবে।” উক্ত রাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জোড়া বস্তু ব্যয় করে, তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ থেকে ডাকা হবে, ‘হে আল্লাহর বান্দাহ! এ দরজাটি উত্তম (এদিকে এস)।’ সুতরাং যে নামাযীদের দলভুক্ত হবে, তাকে নামাযের দরজা থেকে ডাক দেওয়া হবে। আর যে মুজাহিদদের দলভুক্ত হবে। তাকে জিহাদের দরজা থেকে ডাকা হবে। যে রোযাদারদের দলভুক্ত হবে, তাকে ‘রাইয়ান’ নামক দরজা থেকে আহ্বান করা হবে। আর দাতাকে দানের দরজা থেকে ডাকা হবে।” এ সব শুনে আবূ বাক্র (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক, যাকে ডাকা হবে, তার ঐ সকল দরজার তো কোন প্রয়োজন নেই। (কেননা মুখ্য উদ্দেশ্য হল, কোনভাবে জান্নাতে প্রবেশ করা।) কিন্তু এমন কেউ হবে কি, যাকে উক্ত সকল দরজাসমূহ থেকে ডাকা হবে?’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ। আর আশা করি, তুমি তাদের দলভুক্ত হবে।” সাহল ইবনে সা'দ (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “জান্নাতের মধ্যে এমন একটি দরজা আছে, যার নাম হল ‘রাইয়ান’; সেখান দিয়ে কেবল রোযাদারগণই কিয়ামতের দিনে প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউ সেদিক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে, ‘রোযাদাররা কোথায়?’ তখন তারা দণ্ডায়মান হবে। (এবং ঐ দরজা দিয়ে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে) তারপর যখন তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি প্রবেশ করবে, তখন দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর সেখান দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।” (বুখারী ও মুসলিম) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে (অর্থাৎ, জিহাদকালীন বা প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনকল্পে) একদিন রোযা রাখবে, আল্লাহ ঐ একদিন রোযার বিনিময়ে তার চেহারাকে জাহান্নাম হতে সত্তর বছর (পরিমাণ পথ) দূরে রাখবেন।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে নেকীর আশায় রমযানের রোযা পালন করে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” উক্ত রাবী (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মাহে রমযানের আগমন ঘটলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়।” উক্ত রাবী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়। যদি (কালক্রমে) তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় (এবং চাঁদ দেখতে না পাওয়া যায়), তাহলে শা’বান (মাসের) গুণতি ত্রিশ পূর্ণ করে নাও।”
মাহে রমযানে অধিকাধিক সৎকর্ম ও দান খয়রাত করা তথা এর শেষ দশকে আরো বেশী সৎকর্ম করা প্রসঙ্গে
ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত লোকের চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। আর মাহে রমযানে যখন জিব্রাঈল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরো বেশী বদান্যতা প্রদর্শন করতেন। জিব্রাঈল মাহে রমযানের প্রত্যেক রজনীতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁর কাছে কুরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিব্রাঈলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অবশ্যই কল্যাণবহ মুক্ত বায়ু অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন।’ আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘(রমযানের) শেষ দশক প্রবেশ করলে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং রাতে জাগতেন এবং পরিবার-পরিজনদেরকেও জাগাতেন। আর (ইবাদতের জন্য) কোমর বেঁধে নিতেন।’
অর্ধ শা’বানের পর রমযানের এক-দু’দিন আগে থেকে রোযা রাখা নিষেধ। তবে সেই ব্যক্তির জন্য অনুমতি রয়েছে যার রোযা পূর্বের রোযার সাথে মিলিত হয়ে অথবা সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতে অভ্যস্ত হয়ে ঐ দিনে পড়ে
আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন রমযান মাসের এক বা দু’দিন আগে (শা’বানের শেষে) রোযা পালন শুরু না করে। অবশ্য সেই ব্যক্তি রোযা রাখতে পারে, যে ঐ দিনে রোযা রাখতে অভ্যস্ত।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা রমযানের পূর্বে রোযা রেখো না। তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়। আর যদি তার সামনে কোন মেঘ আড়াল করে, তবে (মাসের) ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন শা’বান মাসের অর্ধেক বাকী থাকবে, তখন তোমরা রোযা রাখবে না।” আবূ ইয়াক্বাযান আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সন্দেহের দিনে রোযা রাখল, সে অবশ্যই আবুল কাসেম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাফরমানী করল।’
নতুন চাঁদ দেখলে যা বলতে হয়
ত্বালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন নতুন চাঁদ দেখতেন তখন এই দু‘আ পড়তেন, “আল্লা-হুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি অলঈমা-নি অসসালা-মাতি অলইসলা-ম, রাববী অরাববুকাল্লা-হ, (হিলালু রুশ্দিন অখায়র) ।” অর্থ- হে আল্লাহ! তুমি ঐ চাঁদকে আমাদের উপর উদিত কর নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। (হে চাঁদ) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। (হেদায়াত ও কল্যাণময় চাঁদ!)
সেহরী খাওয়ার ফযীলত। যদি ফজর উদয়ের আশংকা না থাকে, তাহলে তা বিলম্ব করে খাওয়া উত্তম
আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা সেহরী খাও। কেননা, সেহরীতে বরকত নিহিত আছে।” যায়েদ ইবনে সাবেত (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে সেহরী খেয়েছি, অতঃপর নামাযে দাঁড়িয়েছি।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘ওই দুয়ের (নামায ও সেহরীর) মাঝখানে ব্যবধান কতক্ষণ ছিল?’ তিনি বললেন, ‘(প্রায়) পঞ্চাশ আয়াত পড়ার মত সময়।’ ইবনে উমার (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দু’জন মুআয্যিন ছিলেন; বিলাল ও ইবনে উম্মে মাকতূম। একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “বিলাল যখন রাতে আযান দেবে, তখন তোমরা পানাহার (সেহরী ভক্ষণ) কর; যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবনে উম্মে মাকতূম আযান দেবে।” (ইবনে উমার) বলেন, ‘আর তাঁদের উভয়ের আযানের মাঝে এতটুকু ব্যবধান ছিল যে, উনি নামতেন, আর ইনি চড়তেন।’ আম্র বিন আস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমাদের রোযা ও কিতাবধারীদের (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের) রোযার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, সেহরী খাওয়া।”
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে দেরী না করে ইফতার করার ফযীলত, কোন্ খাদ্য দ্বারা ইফতার করবে ও তার পরের দু'আ
সাহ্ল ইবনে সা'দ (রাঃ) রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যতদিন পর্যন্ত মুসলমানেরা শীঘ্র ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে।” আবূ আত্বিয়্যাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আমি ও মাসরূক আয়েশা (রাঃ) নিকট উপস্থিত হলাম। মাসরুক তাঁকে বললেন, ‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহচরদের মধ্যে দু’জন সহচর কল্যাণের ব্যাপারে আদৌ ত্রুটি করেন না। তাঁদের একজন মাগরিব ও ইফতার সত্বর সম্পাদন করেন এবং অপরজন মাগরিব ও ইফতার দেরীতে সম্পাদন করেন।’ এ কথা শুনে আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে মাগরিব ও ইফতার সত্বর করেন?’ তিনি বললেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)।' তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরূপই করতেন।’ আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দাদের মধ্যে যারা দ্রুত ইফতার করে তারাই আমার নিকট বেশি পছন্দনীয়। উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন রাত্রি এ (পূর্ব) দিক থেকে আগমন করবে এবং দিন এ (পশ্চিম) দিক থেকে প্রস্থান করবে এবং সূর্য ডুবে যাবে, তখন অবশ্যই রোযাদার ইফতার করবে।” আবূ ইব্রাহীম আব্দুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রাঃ) তিনি বলেন, (একবার) আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহচর্যে পথ চলছিলাম, তখন তিনি রোযাদার ছিলেন। অতঃপর যখন সূর্য অস্ত গেল, তখন তিনি সফররত সঙ্গীদের একজনকে বললেন, “হে অমুক! বাহন থেকে নেমে আমাদের জন্য ছাতু ঘুলে দাও।” সে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! যদি আর একটু সন্ধ্যা করতেন (তাহলে ভাল হত।)’ তিনি বললেন, “তুমি বাহন থেকে নামো এবং আমাদের জন্য ছাতু ঘুলে দাও।” সে বলল, ‘এখনো দিন হয়ে আছে।’ তিনি আবার বললেন, “তুমি নামো এবং আমাদের জন্য ছাতু ঘুলে দাও।” বর্ণনাকারী বলেন, সুতরাং সে নেমে তাঁদের জন্য ছাতু ঘুলে দিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পান করলেন এবং বললেন, “যখন তোমরা প্রত্যক্ষ করবে যে, রাত্রি এ (পূর্ব) দিক থেকে এসে পড়েছে, তখন অবশ্যই রোযাদার ইফতার করবে।” আর সেই সাথে তিনি পূর্বদিকে ইঙ্গিত করলেন। সালমান ইবনু আমির আয-যাব্বী (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি যখন ইফতার করে তখন তার উচিত খুরমা-খেজুর দিয়ে ইফতার করা। তবে সে যদি খুরমা-খেজুর না পায় তাহলে পানি দিয়ে যেন ইফতার করে, কেননা পানি হচ্ছে পাক-পবিত্র। আনাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায পড়ার আগে কতিপয় টাটকা পাকা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি টাটকা পাকা খেজুর না পেতেন, তাহলে শুকনো কয়েকটি খেজুর যোগে ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুরও না হত, তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন।’
রোযাদার নিজ জিভ ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে রোযার পরিপন্থী ক্রিয়াকলাপ তথা গালি-গালাজ ও অনুরূপ অন্য অপকর্ম থেকে বাঁচিয়ে রাখবে।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন তোমাদের কারো রোযার দিন হবে, সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ না করে ও হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়াই ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে যে, ‘আমি রোযাদার।” উক্ত রাবী (রাঃ) তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও তার উপর আমল করা পরিহার না করল, তখন আল্লাহর কোন দরকার নেই যে, সে তার পানাহার ত্যাগ করুক।”
রোযা সম্পর্কিত কিছু জ্ঞাতব্য বিষয়
আবূ হুরাইরা (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন কোন ব্যক্তি ভুলবশত: কিছু খেয়ে বা পান করে ফেলবে, তখন সে যেন তার রোযা (না ভেঙ্গে) পূর্ণ করে নেয়। কেননা, আল্লাহই তাকে খাইয়েছেন এবং পান করিয়েছেন।” লাক্বীত্ব ইবনে সাবেরাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আমি নিবেদন করলাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! ওযূ সম্পর্কে আমাকে বলুন।’ তিনি বললেন, “পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ কর। আঙ্গুলগুলোর মধ্যবর্তী জায়গাগুলো খিলাল কর। সজোরে নাকে পানি টেনে (নাক ঝাড়ো); তবে রোযার অবস্থায় নয়।” (অর্থাৎ, রোযার অবস্থায় বেশি জোরে নাকে পানি টানা চলবে না।) আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘(কখনো কখনো) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভোর এভাবে হত যে, তিনি স্ত্রী-মিলন হেতু অপবিত্র অবস্থায় থাকতেন। অতঃপর তিনি গোসল করতেন এবং রোযা করতেন।’ আয়েশা (রাঃ) ও উম্মে সালামাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিনা স্বপ্নদোষে (স্ত্রী সহবাসজনিত) অপবিত্র অবস্থায় ভোর করতেন, তারপর রোযা পালন করতেন।
মুহাররম, শা'বান তথা অন্যান্য হারাম (পবিত্র) মাসে রোযা রাখার ফযীলত
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মাহে রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা, আল্লাহর মাস মুহাররম। আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায রাতের (তাহাজ্জুদ) নামায।” আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাবান মাস চাইতে বেশি নফল রোযা অন্য কোন মাসে রাখতেন না। নিঃসন্দেহে তিনি পূর্ণ শাবান মাস রোযা রাখতেন।’ অন্য বর্ণনায় আছে, ‘অল্প কিছুদিন ছাড়া তিনি পূর্ণ শা‘বান মাস রোযা রাখতেন।’ মুজীবাহ আল-বাহিলিয়্যাহ (রাঃ) তার বাবা বা চাচা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট উপস্থিত হন। অতঃপর তিনি চলে যান এবং একবছর পর পুনরায় উপস্থিত হন। তার অবস্থা ও চেহারা-সুরাত সে সময় (অনেক) পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ! আমাকে কি আপনি চিনতে পারছেন না? জবাবে তিনি বললেন, কে তুমি? তিনি বলেন, আমি হলাম সেই বাহিলী, আপনার নিকট প্রথম বছরে এসেছিলাম। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমার এ পরিবর্তন কিভাবে হল, তোমার চেহারা-সুরত না বেশ সুন্দর ছিল? বাহিলী উত্তর দেন, আপনার নিকট হতে বিদায় নেয়ার পর থেকে আমি প্রতি রাতে ব্যতীত আর কখনো খাদ্য গ্রহণ করিনি (প্রতিদিন রোযা রেখেছি)। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, নিজের জীবনকে তুমি কষ্ট দিয়েছ। অতঃপর বললেন, রমজানে রোযা রাখো, এরপর প্রতি মাসে একদিন করে (রোযা রাখো)। বাহিলী বলল, আরো বেশি করে দিন, কারণ আমার ভিতর এর শক্তি আছে। জবাবে বললেন, ঠিক আছে, প্রতি মাসে দু‘দিন করে। বাহিলী বলেন, আমি অধিক সামর্থ্য রাখি। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তবে প্রতি মাসে তিনদিন করে। বাহিলী বলেন, আরো বেশী করুন। জবাবে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হারাম মাসগুলোয় (যিলক্বদ, যিলহাজ্জ, মুহাররাম ও রজব) রোযা রাখো ও ছেড়ে দাও, হারাম মাসগুলোয় রোযা রাখো ও ছেড়ে দাও, হারাম মাসগুলোয় রোযা রাখো ও ছেড়ে দাও। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর নিজের তিন আঙ্গুল দিয়ে তিনি ইশারা করেন, প্রথমে সেগুলোকে মিলিত করেন, তারপর ছেড়ে দেন (অর্থাৎ, তিনদিন রোযা রাখো এবং তিনদিন খাও। (আমি (আলবানী) বলছিঃ এর সনদটি দুর্বল। যেমনটি আমি “আত্তা‘লীকুর রাগীব আলাত্ তারগীব অত্তারহীব” গ্রন্থে (২/৮২) বর্ণনা করেছি। এর সনদের বর্ণনাকারী মুজীবাহ্ বাহেলিয়্যাহ্ সম্পর্কে হাফিয যাহাবী বলেনঃ তিনি গারীব তাকে চেনা যায় না। উল্লেখ্য বর্ণনাকারী আবুস সালীল তার থেকে এককভাবে বর্ণনা করেছেন। এ সনদের মধ্যে মুজীবাহ্ কার থেকে বর্ণনা করেছেন সে ব্যাপারে ইযতিরাবও সংঘটিত হয়েছে। বিস্তারিত দেখুন “য‘ঈফু আবী দাঊদ-আলউম্ম-” গ্রন্থে (নং ৪১৯)।
যুলহজ্জের প্রথম দশকে রোযা পালন তথা অন্যান্য পুণ্যকর্ম করার ফযীলত
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “এই দিনগুলির (অর্থাৎ, যুল হিজ্জার প্রথম দশ দিনের) তুলনায় এমন কোন দিন নেই, যাতে কোন সৎকাজ আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।” লোকেরা বলল, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে কোন (মুজাহিদ) ব্যক্তি যদি তার জান মালসহ বের হয়ে যায় এবং তার কোন কিছুই নিয়ে আর ফিরে না আসে।” (অর্থাৎ, শাহাদত বরণ করে, তাহলে হয়তো তার সমান হতে পারে।)
আরাফা ও মুহার্রাম মাসের নবম ও দশম তারিখে রোযা রাখার ফযীলত
আবূ কাতাদাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরাফার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, “তার পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গোনাহ মোচন করে দেয়।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশূরার (মুহার্রাম মাসের দশম) দিনে স্বয়ং রোযা রেখেছেন এবং ঐ দিনে রোযা রাখতে আদেশ করেছেন। আবূ কাতাদাহ (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আশূরার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, “তা বিগত এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আগামী বছর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে মুহাররম মাসের নবম তারিখে অবশ্যই রোযা রাখব।” (অর্থাৎ, নবম ও দশম দু’দিন ব্যাপী রোযা রাখব।)
শাওয়াল মাসের ছ’দিন রোযা পালনের ফযীলত
আবূ আইয়ূব আনসারী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমযানের রোযা পালনের পর শওয়াল মাসের ছয়দিন রোযা রাখল, সে যেন সারা বছর রোযা রাখল।”
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখার ফযীলত
আবূ কাতাদাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সোমবার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, “ওটি এমন একটি দিন, যেদিন আমার জন্ম হয়েছে, যেদিন আমি (নবীরূপে) প্রেরিত হয়েছি অথবা ঐ দিনে আমার প্রতি (সর্বপ্রথম) ‘অহী’ অবতীর্ণ করা হয়েছে।” আবূ হুরাইরা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “(মানুষের) আমলসমূহ সোম ও বৃহস্পতিবারে (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। তাই আমি ভালবাসি যে, আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোযার অবস্থায় থাকি।” আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সোম ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার জন্য সমধিক সচেষ্ট থাকতেন।’
প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোযা রাখা মুস্তাহাব
আবূ হুরাইরা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে তিনটি কাজের অসিয়ত করেছেন; প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোযা পালন করা। চাশ্তের দু’ রাকআত নামায আদায় করা এবং নিদ্রা যাবার পূর্বে বিত্র নামায পড়া।’ আবূ দারদা (রাঃ) তিনি বলেন, ‘আমার প্রিয় বন্ধু (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে এমন তিনটি কাজের অসিয়ত করেছেন, যা আমি যতদিন বেঁচে থাকব, কখনোই ত্যাগ করব না; প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা পালন করা, চাশ্তের নামায পড়া এবং বিত্র না পড়ে নিদ্রা না যাওয়া।’ ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আম্র ইবনে আ'স (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা রাখা, সারা বছর ধরে রোযা রাখার সমান।” মুআযাহ আদাভিয়্যাহ তিনি আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহর রসূল কি প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা রাখতেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, ‘মাসের কোন্ কোন্ দিনে রোযা রাখতেন?’ তিনি বললেন, ‘মাসের যে কোন দিনে রোযা রাখতে তিনি পরোয়া করতেন না।’ আবূ জর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “প্রত্যেক মাসে (নফল) রোযা পালন করলে (শুক্লপক্ষের) ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে পালন করো।” ক্বাতাদাহ ইবনে মিলহান (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার জন্য আদেশ করতেন।’ ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে ও সফরে কোথাও শুক্লপক্ষের (তিন) দিনের রোযা ছাড়তেন না।’
রোযাদারকে ইফতার করানোর ফযীলত এবং যে রোযাদারের নিকট কিছু ভক্ষণ করা হয় তার ফযীলত এবং যার নিকট ভক্ষণ করা হয় তার জন্য ভক্ষণকারীর দু‘আ।
যায়েদ ইবনে খালেদ জুহানী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে (রোজাদারের) সমান নেকীর অধিকারী হবে। আর তাতে রোজাদারের নেকীর কিছুই কমবে না।” ম্মু ‘উমারা আল-আনসারিয়্যাহ (রাঃ) বী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন একদিন তার নিকট গেলেন। তার সামনে তিনি খাবার রাখলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমিও খাও। তিনি বললেন, আমি তো রোজাদার। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রোজাদারের সামনে যখন খাবার আহার-কারীদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বা পেট ভরে না খাওয়া পর্যন্ত তার (রোজাদারের) জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। আনাস (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সায়াদ ইবনে উবাদাহ (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি রুটি ও (জয়তুনের) তেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে পেশ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ভক্ষণ করে এই দো‘আ পড়লেন, ‘আফত্বারা ইন্দাকুমুস স্বা-য়িমূন, অআকালা ত্বাআমাকুমুল আবরার, অস্বাল্লাত আলাইকুমুল মালাইকাহ।’ অর্থাৎ রোজাদারগণ তোমাদের নিকট ইফতার করল। সৎ ব্যক্তিগণ তোমাদের খাবার ভক্ষণ করল এবং ফেরেশতাগণ তোমাদের (ক্ষমার) জন্য দো‘আ করলেন।