18. তালাক
কোন ঋতুবতী মহিলাকে তার বিনা অনুমতিতে ত্বলাক দেয়া হারাম, যদি কেউ তার বিপরীত করে তাহলে ত্বলাক হয়ে যাবে এবং তাকে তা ফিরিয়ে নিতে আদেশ করতে হবে ।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন ‘উমার (রহ.) তিনি রাসূল এর যুগে তাঁর স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় ত্বলাক্ব দেন। ‘উমার ইব্ন খাত্তাব (রাঃ) এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাকে নির্দেশ দাও, সে যেন তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনে এবং নিজের কাছে রেখে দেয় যতক্ষণ না সে মহিলা পবিত্র হয়ে আবার ঋতুবতী হয় এবং আবার পবিত্র হয়। অতঃপর সে যদি ইচ্ছে করে, তাকে রেখে দিবে আর যদি ইচ্ছে করে তবে সহবাসের পূর্বে তাকে ত্বলাক্ব দেবে। আর এটাই ত্বলাক্বের নিয়ম, যে নিয়মে আল্লাহ্ তা’আলা স্ত্রীদের ত্বলাক্ব দেয়ার বিধান দিয়েছেন। (বুখারী পর্ব ৬৮ : /১, হাঃ ৫২৫১; মুসলিম ১৮/১, হাঃ ১৪৭১) ইউনুস ইবনু যুবায়র (রহ.) তিনি বলেন, আমি ইবনু ‘উমারকে (হায়িয অবস্থায় ত্বলাক্ব দেয়া সম্পর্কে) জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেনঃ ইবনু ‘উমার (রাঃ) তার স্ত্রীকে হায়িয অবস্থায় ত্বলাক্ব দিলে, ‘উমার (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। তিনি স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে আদেশ দেন। এরপর বলেনঃ ইদ্দাতের সময় আসলে সে ত্বলাক্ব দিতে পারে। রাবী বলেন, আমি বললাম, এ ত্বলাক্ব কি হিসাবে ধরা হবে? ইবনু ‘উমার বললেনঃ তবে কি মনে করছ, যদি সে অক্ষম হয় বা বোকামী করে। (তাহলে দায়ী কে?) (বুখারী পর্ব ৬৮: /৪৫ হাঃ ৫৩৩৩, মুসলিম ১৮/১, হাঃ ১৪৭১)
ঐ ব্যক্তির উপর কাফফারাহ ওয়াজিব যে তার স্ত্রীকে হারাম করলো যদিও সে ত্বলাকের নিয়্যাত করেনি।
ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, এরূপ হারাম করে নেয়ার ক্ষেত্রে কাফ্ফারা দিতে হবে। ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) এ-ও বলেছেন যে, “রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম নমুনা।” (বুখারী পর্ব ৬৫ : /৬৬, হাঃ ৪৯১১; মুসলিম ১৮/৩, হাঃ ১৪৭৩) আয়িশাহ (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাইনাব বিন্ত জাহশের নিকট কিছু বিলম্ব করতেন এবং সেখানে তিনি মধু পান করতেন। আমি ও হাফসাহ পরামর্শক্রমে ঠিক করলাম যে, আমাদের মধ্যে যার কাছেই নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রবেশ করবেন, সেই যেন বলি- আমি আপনার থেকে মাগাফীর-এর গন্ধ পাচ্ছি। আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন? এরপর তিনি তাদের একজনের নিকট প্রবেশ করলে তিনি তাঁকে অনুরূপ বললেন। তিনি বললেনঃ বরং আমি যাইনাব বিন্ত জাহশের নিকট মধু পান করেছি। আমি পুনঃ এ কাজ করব না। এ প্রসঙ্গেই অবতীর্ণ হয় (মহান আল্লাহ্র বাণী)- “হে নবী! এমন বস্তুকে হারাম করছেন কেন, যা আল্লাহ্ আপনার জন্য হালাল করেছেন ..(আরবি)..... যদি তোমরা উভয়ে আল্লাহ্র নিকট তাওবা কর” পর্যন্ত। এখানে ‘আয়িশাহ ও হাফসাহ (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। আর আল্লাহ্র বাণী যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিলেন- ‘বরং আমি মধু পান করেছি’-এ কথার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়। (বুখারী পর্ব ৬৮ : /৮, হাঃ ৫২৬৭; মুসলিম ১৮/৩, হাঃ ১৪৭৪) ’আয়িশাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধু ও হালুয়া (মিষ্টি) পছন্দ করতেন। আসরের সালাত শেষে তিনি তাঁর সহধর্মিণীদের নিকট যেতেন। এরপর তাঁদের একজনের ঘনিষ্ঠ হতেন। একদা তিনি হাফসাহ বিন্ত উমারের কাছে গেলেন এবং অন্যান্য দিন অপেক্ষা অধিক সময় অতিবাহিত করলেন। এতে আমি ঈর্ষা করলাম। পরে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে অবগত হলাম যে, তাঁর (হাফসার) গোত্রের জনৈকা মহিলা তাঁকে এক পাত্র মধু হাদিয়া দিয়েছিল। তা থেকেই তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কিছু পান করিয়েছেন। আমি বললামঃ আল্লাহ্র কসম! আমরা এজন্য একটি ফন্দি আঁটব। এরপর আমি সাওদাহ্ বিন্ত যাম‘আকে বললাম, তিনি [আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] তো এখনই তোমার কাছে আসছেন, তিনি তোমার নিকটবর্তী হলেই তুমি বলবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন? তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে বলবেন “না” । তখন তুমি তাঁকে বলবে, তবে আমি কিসের গন্ধ পাচ্ছি? তিনি বলবেনঃ হাফসাহ আমাকে কিছু মধু পান করিয়েছে। তুমি তখন বলবে, এর মৌমাছি মনে হয় ‘উরফুত (এক জাতীয় গাছ) নামক বৃক্ষ থেকে মধু আহরণ করেছে। আমিও তাই বলব। সফীয়্যাহ! তুমিও তাই বলবে। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেনঃ সাওদা (রাঃ) বললেন, আল্লাহ্র কসম! তিনি দরজার নিকট আসতেই আমি তোমার ভয়ে তোমার আদিষ্ট কাজ পালনে প্রস্তুত হলাম। আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁর নিকটবর্তী হলেন, তখন সাওদা বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন? তিনি বললেনঃ না। সাওদা বললেন, তবে আপনার নিকট হতে এ কিসের গন্ধ পাচ্ছি? তিনি বললেনঃ হাফসাহ আমাকে কিছু মধু পান করিয়েছে। সাওদা বললেন, এ মধু মক্ষিকা ‘উরফুত’ নামক বৃক্ষের মধু আহরণ করেছে। এরপর তিনি ঘুরে যখন আমার কাছে এলেন, তখন আমিও অনুরূপ বললাম। তিনি সফীয়্যার কাছে গেলে তিনিও এরূপ উক্তি করলেন। পরদিন যখন তিনি হাফসার কাছে গেলেনঃ তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনাকে মধু পান করাব কি? উত্তরে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এর আমার কোন প্রয়োজন নেই। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন, সাওদা বললেনঃ আল্লাহ্র কসম! আমরা তাঁকে বিরত রেখেছি। আমি বললামঃ চুপ কর। (বুখারী পর্ব ৬৮ : /৮, হাঃ ৫২৬৮; মুসলিম ১৮/৩, হাঃ ১৪৭৪)
যদি কেউ তার স্ত্রীকে ত্বলাকের ইখতিয়ার দেয় তাহলে সেটা ত্বলাক হবে না নিয়্যাত করা ব্যতীত ।
‘আয়িশাহ (রাঃ) যখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর সহধর্মিণীদের ব্যাপারে ইখতিয়ার দেয়ার নির্দেশ দেয়া হল, তখন তিনি প্রথমে আমাকে বললেন, তোমাকে একটি বিষয় সম্পর্কে বলব। তাড়াহুড়ো না করে তুমি তোমার আব্বা ও আম্মার সঙ্গে পরামর্শ করে নিবে। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, তিনি অবশ্যই জানতেন, আমার আব্বা-আম্মা তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলবেন না। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এরপর তিনি বললেন, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেনঃ “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে বলুন, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার ভূষণ কামনা কর.....মহা প্রতিদান পর্যন্ত।” ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এর মধ্যে আমার আব্বা-আম্মার সাথে পরামর্শের কী আছে? আমি তো আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং আখিরাতের জীবন চাই। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্যান্য সহধর্মিণী আমার অনুরূপ জবাব দিলেন। (বুখারী পর্ব ৬৫ : /৩৩, হাঃ ৪৭৮৬; মুসলিম ১৮/৪, হাঃ ১৪৭৫) আয়িশাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের সঙ্গে অবস্থানের পালার ব্যাপারে আমাদের থেকে অনুমতি চাইতেন এ আয়াত নাযিল হওয়ার পরও, আপনি তাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে আপনার নিকট হতে দূরে রাখতে পারেন এবং যাকে ইচ্ছে আপনার নিকট স্থান দিতে পারেন এবং আপনি যাকে দূরে রেখেছেন তাকে কামনা করলে আপনার কোন অপরাধ নেই। এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর মু‘আয বলেন, আমি ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এর উত্তরে কি বলতেন? তিনি বললেন, আমি তাঁকে বলতাম, এ বিষয়ের অধিকার যদি আমার থেকে থাকে তাহলে আমি হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনার ব্যাপারে কাউকে অগ্রাধিকার দিতে চাইনে। (বুখারী পর্ব ৬৫ : /৩৩, হাঃ ৪৭৮৯; মুসলিম ১৮/৪, হাঃ ১৪৭৬) আয়িশাহ (রাঃ) তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের ইখতিয়ার দিলে আমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকেই গ্রহণ করলাম। আর এতে আমাদের ত্বলাক সাব্যস্ত হয়নি। (বুখারী পর্ব ৬৮ : /৫, হাঃ ৫২৬২; মুসলিম ১৮/৪, হাঃ ১৪৭৫)
ঈলা ও স্ত্রী সংসর্গ হতে দূরে থাকা এবং তাদেরকে ইখতিয়ার দেয়া এবং আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ “যদি তার বিরুদ্ধে তোমরা একে অপরকে সাহায্য কর ।” (সূরাহ আল-বাক্বারাহ ২/২২৬)
আবদুল্লাহ ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, ‘উমার ইব্নু খাত্তাব (রাঃ)-কে এ আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য আমি এক বছর অপেক্ষা করেছি। কিন্তু তাঁর ব্যক্তি প্রভাবের ভয়ে আমি তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে সক্ষম হইনি। অবশেষে তিনি হাজ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হলে, আমিও তাঁর সঙ্গে গেলাম। প্রত্যাবর্তনের সময় আমরা যখন কোন একটি রাস্তা অতিক্রম করছিলাম, তখন তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য একটি পিলু গাছের আড়ালে গেলেন। ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, তিনি প্রয়োজন সেরে না আসা পর্যন্ত আমি সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। এরপর তাঁর সঙ্গে পথ চলতে চলতে বললাম, হে আমীরুল মু’মিনীন! নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদের কোন্ দু’জন তার বিপক্ষে একমত হয়ে পরস্পর একে অন্যকে সহযোগিতা করেছিলেন? তিনি বললেন, তাঁরা দু’জন হল হাফসাহ ও ‘আয়িশাহ (রাঃ)। ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, আল্লাহ্র শপথ! আমি আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য এক বছর যাবত ইচ্ছে করেছিলাম। কিন্তু আপনার ভয়ে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। তখন ‘উমার (রাঃ) বললেন, অমন করবে না। যে বিষয়ে তুমি মনে করবে যে, আমি তা জানি, তা আমাকে জিজ্ঞেস করবে। এ বিষয়ে আমার জানা থাকলে আমি তোমাকে জানিয়ে দেব। তিনি বলেন, এরপর ‘উমার (রাঃ) বললেন, আল্লাহ্র শপথ! জাহিলী যুগে মহিলাদের কোন অধিকার আছে বলে আমরা মনে করতাম না। অবশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে যে বিধান নাযিল করার ছিল তা নাযিল করলেন এবং তাদের হক হিসাবে যা নির্দিষ্ট করার ছিল তা নির্দিষ্ট করলেন। তিনি বলেন, একদা আমি কোন এক বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলাম, এমতাবস্থায় আমার স্ত্রী আমাকে বললেন, কাজটি যদি তুমি এভাবে এভাবে কর (তাহলে ভাল হবে)। আমি বললাম, তোমার কী প্রয়োজন? এবং আমার কাজে তোমার এ অনধিকার চর্চা কেন? সে আমাকে বলল, হে খাত্তাবের বেটা! কী আশ্চর্য, তুমি চাও না যে, আমি তোমার কথার উত্তর দান করি অথচ তোমার কন্যা হাফ্সাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথার পিঠে কথা বলে থাকে। এমনকি একদিন তো সে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রাগান্বিত করে ফেলে। এ কথা শুনে ‘উমার (রাঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং চাদরখানা নিয়ে তার বাড়িতে চলে গেলেন। তিনি তাকে বললেন, বেটী! তুমি নাকি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথার প্রতি-উত্তর করে থাক। ফলে তিনি দিনভর মনঃক্ষুণ্ণ থাকেন। হাফ্সাহ (রাঃ) বলেন, আল্লাহ্র কসম! আমরা তো অবশ্যই তাঁর কথার জবাব দিয়ে থাকি। ‘উমার (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, জেনে রাখ! আমি তোমাকে আল্লাহ্র শাস্তি এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসন্তুষ্টি সম্পর্কে সতর্ক করছি। রূপ-সৌন্দর্যের কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভালবাসা যাকে গর্বিতা করে রেখেছে, সে যেন তোমাকে প্রতারিত না করতে পারে। এ কথা বলে ‘উমার (রাঃ) ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে বোঝাচ্ছিলেন। ‘উমার (রাঃ) বলেন, এরপর আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম এবং উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর ঘরে প্রবেশ করলাম ও এ বিষয়ে তাঁর সাথে কথাবার্তা বললাম। কারণ, তাঁর সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তখন উম্মু সালামাহ (রাঃ) বললেন, হে খাত্তাবের বেটা! কী আশ্চর্য, তুমি প্রত্যেক ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করছ, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার স্ত্রীদের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছ। আল্লাহ্র কসম! তিনি আমাকে এমন কঠোরভাবে ধরলেন যে, আমার গোস্বাকে একেবারে শেষ করে দিলেন। এরপর আমি তাঁর কাছ থেকে চলে আসলাম। আমার একজন আনসার বন্ধু ছিল। যদি আমি কোন মজলিশ থেকে অনুপস্থিত থাকতাম তাহলে সে এসে মজলিশের খবর আমাকে জানাত। আর সে যদি অনুপস্থিত থাকত তাহলে আমি এসে তাকে মজলিশের খবর জানাতাম। সে সময় আমরা গাস্সানী বাদশাহ্র আক্রমণের আশংকা করছিলাম। আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে, সে আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য যাত্রা করেছে। তাই আমাদের হৃদয়-মন এ ভয়ে শংকিত ছিল। এমন সময় আমার আনসার বন্ধু এসে দরজায় করাঘাত করে বললেন, দরজা খুলুন, দরজা খুলুন। আমি বললাম, গাস্সানীরা এসে পড়েছে নাকি? তিনি বললেন, বরং এর চেয়েও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সহধর্মিণীদের থেকে পৃথক হয়ে গেছেন। তখন আমি বললাম, হাফ্সাহ ও ‘আয়িশাহর নাক ধূলায় ধুসরিত হোক। এরপর আমি কাপড় নিয়ে বেরিয়ে চলে আসলাম। গিয়ে দেখলাম, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি উঁচু টঙে অবস্থান করছেন। সিঁড়ি বেয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়। সিঁড়ির মুখে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একজন কালো গোলাম বসা ছিল। আমি বললাম, বলুন, ‘উমার ইব্নু খাত্তাব এসেছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে অনুমতি দিলেন, আমি তাঁকে এসব ঘটনা বললাম, এক পর্যায়ে আমি যখন উম্মু সালামাহর কপোপকথন পর্যন্ত পৌঁছলাম তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুচকি হাসলেন। এ সময় তিনি একটা চাটাইয়ের উপর শুয়ে ছিলেন। চাটাই এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাঝে আর কিছুই ছিল না। তাঁর মাথার নিচে ছিল খেজুরের ছালভর্তি চামড়ার একটি বালিশ এবং পায়ের কাছে ছিল সল্ম বৃক্ষের পাতার একটি স্তূপ ও মাথার উপর লটকানো ছিল চামড়ার একটি মশক। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একপার্শ্বে চাটাইয়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেললে তিনি বললেন, তুমি কেন কাঁদছ? আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! কিসরা ও কায়সার পার্থিব ভোগ-বিলাসের মধ্যে ডুবে আছে, অথচ আপনি আল্লাহ্র রাসূল। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি পছন্দ করো না যে, তারা দুনিয়া লাভ করুক, আর আমরা আখিরাত লাভ করি। (বুখারী পর্ব ৬৫ : /৬৬, হাঃ ৪৯১৩; মুসলিম ১৮/৫, হাঃ ১৪৭৯) আবদুল্লাহ্ ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেন, আমি বহুদিন ধরে উৎসুক ছিলাম যে, আমি ‘উমার ইব্নু খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করব, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিবিগণের মধ্যে কোন্ দু’জন সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেছেনঃ “তোমরা দু’জন যদি আল্লাহ্র নিকট তাওবাহ কর (তবে এটা উত্তম) কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।” এরপর একবার তিনি [‘উমার (রাঃ)] হাজ্জের জন্য রওয়ানা হলেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে হাজ্জে গেলাম। (ফিরে আসার পথে) তিনি ইস্তিনজার জন্য রাস্তা থেকে সরে গেলেন। আমি পানি পূর্ণ পাত্র হাতে তাঁর সাথে গেলাম। তিনি ইস্তিনজা করে ফিরে এলে আমি ওযূর পানি তাঁর হাতে ঢেলে দিতে লাগলাম। তিনি যখন ওযূ করছিলেন, তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আমীরুল মু’মিনীন! নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহধর্মিণীগণের মধ্যে কোন্ দু’জন, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেনঃ “তোমরা দু’জন যদি আল্লাহ্র কাছে তাওবাহ কর (তবে তোমাদের জন্য উত্তম), কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।” জবাবে তিনি বললেন, হে ইব্নু ‘আব্বাস! আমি তোমার প্রশ্ন শুনে অবাক হচ্ছি। তাঁরা দুজন তো ‘আয়িশাহ (রাঃ) ও হাফসাহ (রাঃ)। এরপর ‘উমার (রাঃ) এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেন, “আমি এবং আমার একজন আনসারী প্রতিবেশি যিনি উমাইয়াহ ইব্নু যায়দ গোত্রের লোক এবং তারা মাদীনাহর উপকন্ঠে বসবাস করত। আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গে পালাক্রমে সাক্ষাত করতাম। সে একদিন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে যেত, আমি আর একদিন যেতাম। যখন আমি দরবারে যেতাম, ঐ দিন দরবারে ওয়াহী অবতীর্ণসহ যা ঘটত সবকিছুর খবর আমি তাকে দিতাম এবং সেও অনুরূপ খবর আমাকে দিত। আমরা কুরাইশরা নিজেদের স্ত্রীগণের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা যখন আনসারদের মধ্যে এলাম, তখন দেখতে পেলাম, তাদের স্ত্রীগণ তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করে চলেছে। সুতরাং আমাদের স্ত্রীরাও তাদের দেখাদেখি সেরূপ ব্যবহার করতে লাগল। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি নারাজ হলাম এবং তাকে উচ্চঃস্বরে কিছু বললাম, সেও প্রতি-উত্তর দিল। আমার কাছে এ রকম প্রতি-উত্তর দেয়াটা অপছন্দ হল। সে বলল, আমি আপনার কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছি এতে অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহ্র কসম, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিবিগণ তাঁর কথার মুখে মুখে পাল্টা উত্তর দিয়ে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একদিন এক রাত পর্যন্ত কথা না বলে কাটান। [‘উমার (রাঃ) বলেন], এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম এবং আমি বললাম, তাদের মধ্যে যারা এরূপ করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি আমার কাপড় পরিধান করলাম এবং আমার কন্যা হাফসাহর ঘরে প্রবেশ করলাম এবং বললামঃ হাফ্সা! তোমাদের মধ্য থেকে কারো প্রতি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি সারা দিন রাত পর্যন্ত অসন্তুষ্ট থাকেননি? সে উত্তর করল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। তোমরা কি এ ব্যাপারে ভীত হচ্ছো না যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন? পরিণামে তোমরা ধ্বংসের মধ্যে পড়ে যাবে। সুতরাং তুমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অতিরিক্ত কোন জিনিস দাবি করবে না এবং তাঁর কথার প্রতি-উত্তর করবে না এবং তাঁর সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না। তোমার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমার কাছে চেয়ে নেবে। আর তোমার সতীন তোমার চেয়ে অধিক রূপবতী এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অধিক প্রিয়- তা যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এখানে সতীন বলতে ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে বোঝানো হয়েছে। ‘উমার (রাঃ) আরো বলেন, এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাস্সানের শাসনকর্তা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশ্যে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রস্তুত করছে। আমার প্রতিবেশি আনসার তার পালার দিন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমত থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় খুব জোরে করাঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কিনা? আমি শংকিত অবস্থায় বেরিয়ে এলাম। সে বলল, আজ এক বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কী? গাস্সানিরা কি এসে গেছে? সে বলল, না তার চেয়েও বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সহধর্মিণীগণকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফ্সা তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হলো। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, খুব শীগগীরই এরকম একটা কিছু ঘটবে। এরপর আমি পোশাক পরিধান করলাম এবং ফজরের সালাত নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে আদায় করলাম। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহণ করলেন, আমি তখন হাফ্সার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে পূর্বেই সতর্ক করে দেইনি? নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদের সকলকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন? সে বলল, আমি জানি না। তিনি ওখানে ওপরের কামরায় একাকী রয়েছেন। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মিম্বরের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমি এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিলাম না। সুতরাং যে ওপরের কামরায় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থান করছিলেন আমি সেই ওপরের কামরায় গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদিমকে বললাম, তুমি কি উমারের জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে যাবার অনুমতি এনে দেবে? খাদিমটি গেল এবং নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আপনার কথা বলেছি; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম! তুমি কি উমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে প্রবেশ করল এবং ফিরে এসে বলল, আপনার কথা বলেছি কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুপ থেকেছেন। তাই আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সাথে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি উমারের জন্য অনুমতি এনে দেবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। যখন আমি ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছি, এমন সময় খাদিমটি আমাকে ডেকে বলল, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইর ওপর চাদরবিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে পরিষ্কার চাটাইয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে সালাম করলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি কি আপনার বিবিগণকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না (অর্থাৎ ত্বলাক্ব দেইনি)। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার। এরপর আলাপটা নমনীয় করার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে থেকেই বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি যদি শোনেন তাহলে বলিঃ আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের ওপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাতাম; কিন্তু আমরা মাদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের ওপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুচকি হাসলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! যদি আপনি আমার কথার দিকে একটু নজর দেন। আমি হাফ্সার কাছে গেলাম এবং আমি তাকে বললাম, তোমার সতীনের রূপবতী হওয়া ও রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রিয় পাত্রী হওয়া তোমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে। এর দ্বারা ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুনরায় মুচকি হাসলেন। আমি তাঁকে হাসতে দেখে বসে পড়লাম। এরপর আমি তাঁর ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আল্লাহ্র কসম, শুধুমাত্র তিনটি চামড়া ব্যতীত আর আমি তাঁর ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখতে পেলাম না। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা‘আলা যাতে আপনার উম্মাতদের সচ্ছলতা দান করেন। কেননা, পারস্য ও রোমানদের প্রাচুর্য দান করা হয়েছে এবং তাদের দুনিয়ার আরাম প্রচুর পরিমাণে দান করা হয়েছে; অথচ তারা আল্লাহ্র ‘ইবাদাত করে না। এ কথা শুনে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সোজা হয়ে বসে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণা পোষণ করছ? ওরা ঐ লোক, যারা উত্তম কাজের প্রতিদান এ দুনিয়ায় পাচ্ছে! আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল, আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহ্র কাছে দোয়া করুন। হাফ্সা (রাঃ) কর্তৃক ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঊনত্রিশ দিন তাঁর বিবিগণ থেকে আলাদা থাকেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, আমি এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাব না তাদের প্রতি গোস্বার কারণে। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। সুতরাং যখন ঊনত্রিশ দিন হয়ে গেল, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে দিয়েই শুরু করলেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি কসম করেছেন যে, একমাসের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেন না; কিন্তু এখন তো ঊনত্রিশ দিনেই এসে গেলেন। আমি প্রতিটি দিন এক এক করে হিসাব করে রেখেছি। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ঊনত্রিশ দিনেও একমাস হয়। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এ মাস ২৯ দিনের। ‘আয়িশাহ (রাঃ) আরও বলেন, ঐ সময় আল্লাহ্ তা‘আলা ইখতিয়ারের (সূরা আহযাবের ২৮নং) আয়াত নাযিল করেন এবং তিনি তাঁর বিবিগণের মধ্যে আমাকে দিয়েই শুরু করেন এবং আমি তাঁকেই গ্রহণ করি। এরপর তিনি অন্য বিবিগণের অভিমত চাইলেন। সকলেই তাই বলল, যা ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছিলেন। (বুখারী পর্ব ৬৭ : /৮৩, হাঃ ৫১৯১; মুসলিম ১৮/৫, হাঃ ১৪৭৯)
তিন ত্বলাকপ্রাপ্তা মহিলার খরচ বা ব্যয় ভার নেই ।
আয়িশাহ (রাঃ) তিনি বলেনঃ ফাতিমার কী হল? সে কেন আল্লাহ্কে ভয় করছে না অর্থাৎ তার এ কথায় যে, ত্বলাক্বপ্রাপ্তা নারী (তার স্বামীর থেকে) খাদ্য ও বাসস্থান কিছুই পাবে না। (বুখারী পর্ব ৬৮ : /৪১, হাঃ ৫৩২৪; মুসলিম ১৮/৬, হাঃ ১৪৮১) কাসিম (রহ.) ‘উরওয়াহ ইবনু যুবায়র (রহ.) ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলঃ আপনি কি জানেন না, হাকামের কন্যা অমুককে তার স্বামী তিন ত্বলাক্ব দিলে, সে (তার পিতার ঘরে) চলে গিয়েছিল। তিনি বললেনঃ এ হাদীস বর্ণনায় তার কোন কল্যাণ নেই। (বুখারী পর্ব ৬৮: /৪১, হাঃ ৫৩২৬; মুসলিম ১৮/৬, হাঃ ১৪৮১)
বিধবা স্ত্রী বা অন্যদের সন্তান প্রসবের মাধ্যমে ইদ্দাত পূর্ণ করার বর্ণনা ।
সুবায়‘আহ বিনতুল হারিস তিনি বলেন, তিনি বানু আমির ইব্নু লুয়াই গোত্রের সাদ ইব্নু খাওলার স্ত্রী ছিলেন, সা‘দ (রাঃ) বাদ্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ছিলেন। তিনি বিদায় হজ্জের বছর মারা যান। তখন তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। তার ইন্তিকালের কিছুদিন পরেই তিনি সন্তান প্রসব করলেন। এরপর নিফাস থেকে পবিত্র হয়েই তিনি বিবাহের পয়গাম দাতাদের উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা আরম্ভ করলেন। এ সময় আবদুদ্দার গোত্রের আবুস সানাবিল ইব্নু বা’কাক নামক এক ব্যক্তি তাকে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার, আমি তোমাকে দেখছি যে, তুমি বিবাহের আশায় পয়গাম দাতাদের উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা আরম্ভ করে দিয়েছ? আল্লাহ্র কসম চার মাস দশদিন অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তুমি বিবাহ করতে পারবে না। সুবায়‘আহ (রাঃ) বলেন, (আবুস সানাবিল আমাকে) এ কথা বলার পর আমি ঠিকঠাক মত কাপড় চোপড় পরিধান করে বিকেল বেলা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট গেলাম এবং এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, যখন আমি সন্তান প্রসব করেছি তখন থেকেই আমি হালাল হয়ে গেছি। এরপর তিনি আমাকে বিয়ে করার নির্দেশ দিলেন যদি আমার ইচ্ছে হয়। (বুখারী পর্ব ৬৪ : /১০, হাঃ ৩৯৯১; মুসলিম ১৮/৮, হাঃ ১৪৮৪) আবু সালামাহ (রহ.) তিনি বলেন, আবু হুরাইরাহ (রাঃ) ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে ছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে এলেন এবং বললেন, এক মহিলা তার স্বামীর মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর বাচ্চা প্রসব করেছে। সে এখন কিভাবে ইদ্দত পালন করবে, এ বিষয়ে আমাকে ফাতাওয়া দিন। ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) বললেন, ইদ্দত সম্পর্কিত হুকুম্ দু’টির যেটি দীর্ঘ, তাকে সেটি পালন করতে হবে। আবু সালামাহ (রহ.) বলেন, আমি বললাম, আল্লাহ্র হুকুম তো হলঃ গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, আমি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র অর্থাৎ আবু সালামাহর সঙ্গে আছি। তখন ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) তাঁর ক্রীতদাস কুরায়বকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করার জন্য উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর কাছে পাঠালেন। তিনি বললেন, সুরায়‘আহ আসলামিয়া (রাঃ)-এর স্বামীকে হত্যা করা হল, তিনি তখন গর্ভবতী ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তিনি সন্তান প্রসব করলেন। এরপরই তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হল। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বিয়ে করিয়ে দিলেন। যারা তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আবুস্ সানাবিল তাদের মধ্যে একজন। (বুখারী পর্ব ৬৫ : /২, হাঃ ৪৯০৯; মুসলিম ১৮/৮, হাঃ ১৪৮৫)
স্বামী মারা গেলে মহিলার জন্য ইদ্দাত পর্যন্ত শোক পালন করা ওয়াজিব এবং অন্যদের তিনদিনের বেশি শোক পালন নিষিদ্ধ ।
যাইনাব বিন্ত আবু সালামাহ (রাঃ) তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহধর্মিণী উম্মু হাবীবার পিতা আবু সুফ্ইয়ান ইবনু হারব (রাঃ) মৃত্যুবরণ করলে আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হই। উম্মু হাবীবাহ (রাঃ) যা‘ফরান ইত্যাদি মিশ্রিত হলদে রং এর খুশবু নিয়ে আসতে বললেন। তিনি এক বালিকাকে এ থেকে কিছু মাখালেন। এরপর তাঁর নিজের চেহারার উভয় পার্শ্বে কিছু মাখলেন। এরপর বললেনঃ আল্লাহ্র কসম! খুশবু ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন আমার নেই। তবে আমি আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাসী কোন মহিলার জন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালন করা বৈধ হবে না। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। যাইনাব (রাঃ) বলেনঃ যাইনাব বিন্ত জাহ্শের ভাই মৃত্যুবরণ করলে আমি তার (যাইনাবের) নিকট গেলাম। তিনিও খুশবু আনিয়ে কিছু ব্যবহার করলেন। এরপর বললেনঃ আল্লাহ্র কসম! খুশবু ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন আমার নেই। তবে আমি আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ্ পরকালে বিশ্বাসী কোন মহিলার জন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালন করা বৈধ হবে না তবে তার স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস দশ দিন শোক পালন করতে পারবে। যাইনাব (রাঃ) বলেনঃ আমি উম্মু সালামাহকে (রাঃ) বলতে শুনেছিঃ এক মহিলা আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে বললঃ হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার মেয়ের স্বামী মারা গেছে। তার চোখে অসুখ। তার চোখে কি সুরমা লাগাতে পারবে? তখন আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’ তিন বার বললেন, না। তিনি আরও বললেনঃ এতো মাত্র চার মাস দশ দিনের ব্যাপার। অথচ বর্বরতার যুগে এক মহিলা এক বছরের মাথায় বিষ্ঠা নিক্ষেপ করত। হুমায়দ্ বলেন, আমি যাইনাবকে জিজ্ঞেস করলাম, এক বছরের মাথায় বিষ্ঠা নিক্ষেপ করার অর্থ কী? তিনি বলেন, সে যুগে কোন মহিলার স্বামী মারা গেলে সে অতি ক্ষুদ্র একটি কোঠায় প্রবেশ করতো এবং নিকৃষ্ট কাপড় পরিধান করত, কোন খুশবু ব্যবহার করতে পারত না। এভাবে এক বছর অতিক্রান্ত হলে তার কাছে চতুষ্পদ জন্তু যথা- গাধা, বকরী অথবা গাভী আনা হতো। আর সে তার গায়ে হাত বুলাতো। হাত বুলাতে বুলাতে অনেক সময় সেটা মারাও যেত। এরপর সে (মহিলা) বেরিয়ে আসতো। তাকে বিষ্ঠা দেয়া হতো এবং তা তাকে নিক্ষেপ করতে হতো। এরপর ইচ্ছে করলে সে খুশবু ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারত। মালিক (রহ.)-কে –(আরবি)- শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “মহিলা ঐ প্রাণীর চামড়ায় হাত বুলাতো”। (বুখারী পর্ব ৬৮: /৪৬, হাঃ ৫৩৩৪-৫৩৩৭; মুসলিম ১৮/৯, হাঃ ১৪৮৬-১৪৭৯) উম্মু ‘আতিয়্যাহ (রাঃ) তিনি বলেনঃ কোন মৃত ব্যক্তির জন্যে আমাদেরকে তিন দিনের অধিক শোক পালন করা হতে নিষেধ করা হতো। কিন্তু স্বামীর ক্ষেত্রে চার মাস দশদিন (শোক পালনের অনুমতি ছিল)। আমরা তখন সুরমা লাগাতাম না, সুগন্ধি ব্যবহার করতাম না, ইয়েমেনের তৈরি রঙিন কাপড় ছাড়া অন্য কোন রঙিন কাপড় পরিধান করতাম না। তবে হায়য হতে পবিত্রতার গোসলে আজফারের খোশ্বু মিশ্রিত বস্ত্রখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি ছিল। আর আমাদের জানাযার পেছনে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল । এই বর্ণনা হিশাম ইব্নু হাস্সান (রহ.) হাফসা (রাঃ) হতে, তিনি উম্মে ‘আতিয়্যা (রাঃ) হতে এবং তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বিবৃত করেছেন । (বুখারী পর্ব ৬ : /১২, হাঃ ৩১৩; মুসলিম ১৮/৯, হাঃ ৯৩৮)