54. তাফসীর
তাফসীর
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, বনী ইসরাঈলকে আদেশ দেয়া হয়েছিল, তোমরা দরজা দিয়ে অবনত মস্তকে প্রবেশ কর আর মুখে বল, ‘হিত্তাতুন’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দাও।) কিন্তু তারা এ শব্দটি পরিবর্তন করে ফেলল এবং প্রবেশ দ্বারে যেন নতজানু হতে না হয় সে জন্য তারা নিজ নিজ নিতম্বের ওপর ভর দিয়ে শহরে প্রবেশ করল আর মুখে বলল, ‘হাব্বাতুন্ ফী শা‘আরাতিন” (অর্থাৎ হে আল্লাহ্! আমাদেরকে যবের দানা দাও)। (বুখারী পর্ব ৬০ অধ্যায় ২৮ হাদীস নং ৩৪০৩; মুসলিম ৩০১৭ আনাস ইব্নু মালিক (রাঃ) তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ক্রমাগত ওয়াহী অবতীর্ণ করতে থাকেন এবং তাঁর ইন্তিকালের নিকটবর্তী সময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রতি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ওয়াহী অবতীর্ণ করেন। এরপর তাঁর ওফাত হয়। (বুখারী পর্ব ৬৬ অধ্যায় ১ হাদীস নং ৪৯৮২; মুসলিম ৫৪/হাঃ ৩০১৬) ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এক ইয়াহূদী তাঁকে বললঃহে আমীরুল মু’মিনীন! আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যা আপনারা পাঠ করে থাকেন, তা যদি আমাদের ইয়াহুদী জাতির উপর অবতীর্ণ হত, তবে অবশ্যই আমরা সে দিনকে খুশীর দিন হিসেবে পালন করতাম। তিনি বললেন, কোন্ আয়াত? সে বললঃ“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম” (সূরাহ মায়িদাহ্ ৫/৩)। ‘উমার (রাঃ) বললেন, এটি যে দিনে এবং যে স্থানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল তা আমরা জানি; তিনি সেদিন ‘আরাফায় দাঁড়িয়েছিলেন এবং তা ছিল জুমু‘আর দিন। (বুখারী পর্ব ২ অধ্যায় ৩৩ হাদীস নং ৪৫; মুসলিম ৪৩/১ হাঃ ৩০১৭) ‘উরওয়াহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) তিনি একবার ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ“আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, ইয়াতীম বালিকাদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না তাহলে অন্য মহিলাদের মধ্য হতে তোমাদের পছন্দ মতো দু’জন বা তিনজন কিংবা চারজনকে বিয়ে করতে পার” (আন-নিসাঃ৩)। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ‘আয়িশাহ (রাঃ) বললেন, আমার ভাগিনা! এ হচ্ছে সেই ইয়াতীম মেয়ের কথা, যে অভিভাবকের আশ্রয়ে থাকে এবং তার সম্পদে অংশীদার হয়। এদিকে মেয়ের ধন-রূপে মুগ্ধ হয়ে তার অভিভাবক মোহরানার ব্যাপারে সুবিচার না করে অর্থাৎ, অন্য কেউ যে পরিমাণ মোহরানা দিতে রাজী হত, তা না দিয়েই তাকে বিয়ে করতে চাইত। তাই প্রাপ্য মোহরানা আদায়ের মাধ্যমে সুবিচার না করা পর্যন্ত তাদেরকে আশ্রিতা ইয়াতীম বালিকাদের বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং পছন্দমত অন্য মহিলাদেরকে বিয়ে করতে বলা হয়েছে। ‘উরওয়াহ (রাঃ) বলেন, ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন, পরে সাহাবীগণ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট (মহিলাদের সম্পর্কে) ফাতওয়া জিজ্ঞেস করলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেন “তারা আপনার নিকট মহিলাদের সম্পর্কে ফাতওয়া জিজ্ঞেস করে, আপনি বলুন, আল্লাহই তাদের সম্পর্কে তোমাদের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর ইয়াতীম মেয়েদের সম্পর্কে কিতাব হতে তোমাদেরকে পাঠ করে শোনানো হয়, তাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ রয়েছে, তা তোমরা তাদের দাও না অথচ তাদের তোমরা বিয়ে করতে চাও” (আন-নিসাঃ১২৭)। “আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে অন্য নারীদের মধ্যে হতে তোমাদের পছন্দ মতো দু’জন বা তিনজন কিংবা চারজন বিয়ে করতে পারবে”। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আর অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার ইরশাদ এর মর্ম হল, “ধন ও রূপের স্বল্পতা হেতু তোমাদের আশ্রিতা ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি তোমাদের অনাগ্রহ”। তাই ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি অনাগ্রহ সত্ত্বেও শুধু ধন-রূপের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদের বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছে। অবশ্য ন্যায়সঙ্গত মোহরানা আদায় করে বিয়ে করতে পারে। (বুখারী পর্ব ৪৭ অধ্যায় ৭ হাদীস নং ২৪৯৪; মুসলিম ৩০১৮) ‘আয়িশাহ (রাঃ) তিনি বলেন, কুরআনের আয়াতঃ“যে অভাবমুক্ত সে যেন নিবৃত্ত থাকে এবং যে অভাবগ্রস্ত সে যেন সঙ্গত পরিমাণে ভোগ করে” (সূরাহ আন-নিসা ৪/৬)। ইয়াতীমের ঐ অভিভাবক সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়, যে তার তত্ত্বাবধান করে ও তার সম্পত্তির পরিচর্যা করে, সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়, তবে তা হতে নিয়মমাফিক খেতে পারবে। (বুখারী পর্ব ৩৪ অধ্যায় ৯৫ হাদীস নং ২২১২; মুসলিম ৫৪ অধ্যায়ের প্রথমে হাঃ ৩০১৯) ‘আয়িশাহ (রাঃ) “কোন স্ত্রী যদি স্বামীর অবজ্ঞা ও উপেক্ষার ভয় করে” (সূরাহ আন-নিসা ৪/১২৮) আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তিনি (‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর কাছে বেশী যাওয়া-আসা করত না বরং তাকে পরিত্যাগ অর্থাৎ তালাক দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করত। এ অবস্থায় স্ত্রী বলল, আমি তোমাকে আমার ব্যাপারে দায়মুক্ত করে দিলাম। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (বুখারী পর্ব ৪৬ অধ্যায় ১১ হাদীস নং ২৪৫০; মুসলিম ৩০২১) সা‘ঈদ ইবনু যুবায়র (রাঃ) তিনি বলেছেন যে, এ আয়াত সম্পর্কে কূফাবাসীগণ ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করল। (কেউ বলেন মানসূখ, কেউ বলেন মানসূখ নয়। এ ব্যাপারে আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে গেলাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরে তিনি বললেন, (আরবি) আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে এবং এটি শেষের দিকে অবতীর্ণ আয়াত; এটাকে কোন কিছু রহিত করেনি। (বুখারী পর্ব ৬৫ সূরা (৪) আন-নিসা অধ্যায় ১৬ হাদীস নং ৪৫৯০; মুসলিম ৫৪/হাঃ ৩০২৩) সাঈদ ইব্নু যুবায়র (রাঃ) তিনি বলেন, ইব্নু আবযা (রাঃ) বলেন, ইব্নু ‘আব্বাসকে জিজ্ঞেস করা হল, আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ“কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মু’মিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম” এবং আল্লাহ্র এ বাণীঃ“এবং আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীত, তারা তাকে হত্যা করে না” এবং “কিন্তু যারা তাওবাহ করে” পর্যন্ত, সম্পর্কে আমিও তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি জবাবে বললেন, যখন এ আয়াত নাযিল হল তখন মাক্কাহবাসী বলল, আমরা আল্লাহ্র সাথে শারীক করেছি, আল্লাহ্ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করেছি এবং আমরা অশ্লীল কার্যে লিপ্ত হয়েছি। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন, “যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে।” ......আল্লাহ্ ক্ষমামীল, পরম দয়ালু......পর্যন্ত। (বুখারী পর্ব ৬৫ সূরা (২৫) আল-ফুরকান অধ্যায় ৩ হাদীস নং ৪৭৬৫; মুসলিম ৫৪/হাঃ ৩০২৩) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) তিনি বলেছেন যে, (আরবী) আয়াতের ঘটনা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তির কিছু ছাগল ছিল, মুসলিমদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলে সে তাঁদেরকে বলল “আস্সালামু আলাইকুম”, মুসলিমরা তাকে হত্যা করল এবং তার ছাগলগুলো নিয়ে নিল, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করলেন (আরবী) পার্থিব সম্পদের লোভে আর সে সম্পদ হচ্ছে এ ছাগল পাল। ‘আত্বা (রহ.) বলেন, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)(আরবী) পড়েছেন। (বুখারী পর্ব ৬৫ সূরা (৪) আন্-নিসা অধ্যায় ১৭ হাদীস নং ৪৫৯১; মুসলিম ৩২২৫ আবূ ইসহাক (রহ.) তিনি বলেন, আমি বারা (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, এ আয়াতটি আমাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। হাজ্জ করে এসে আনসারগণ তাদের বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন। এক আনসার ফিরে এসে তার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে তাকে এ জন্য লজ্জা দেয়া হয়। তখনই নাযিল হয়ঃ“পশ্চাৎ দিক দিয়ে তোমাদের গৃহ-প্রবেশ করাতে কোন কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ আছে যে তাকওয়া অবলম্বন করে। সুতরাং তোমরা (সামনের) দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ কর” (সূরাহ আল-বাক্বারাহ ২/১৮৯)। (বুখারী পর্ব ২৬ অধ্যায় ১৮ হাদীস নং ১৮০৩; মুসলিম ৫৪/৫৪, হাঃ ৩০২৬)
আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃতারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে। (সূরাহ বানী ইসরাঈল ১৭/৫৭)
‘আবদুল্লাহ্ (রাঃ) {إِلَى رَبِّهِمْ الْوَسِيلَةَ} তিনি আয়াতটি সম্পর্কে বলেন, কিছু মানুষ কিছু জিনের ‘ইবাদাত করত। সেই জিনেরা তো ইসলাম গ্রহণ করে ফেলল। আর ঐ লোকজন তাদের (পুরাতন) ধর্ম আঁকড়ে রইল। (বুখারী পর্ব ৬৫ সূরা (১৭) আল-ইসরা অধ্যায় ৭ হাদীস নং ৪৭১৪; মুসলিম ৫৪/৪, হাঃ ৩০৩০)
সূরাহ বারাআ (৯), সূরাহ আল-আনফাল (৮) ও সূরাহ আল-হাশর (৫৯)
সাঈদ ইব্নু যুবায়র (রাঃ) তিনি বলেন, আমি ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ)-কে সূরাহ তাওবাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এ তো লাঞ্ছনাকারী সূরা। অর্থাৎ তাদের একদল এই করেছে, আরেক দল ওই করেছে, এ বলে একাধারে এ সূরাহ অবতীর্ণ হতে থাকলে লোকেরা ধারণা করতে লাগলো যে, এ সূরায় উল্লেখ করা হবে না, এমন কেউ আর তাদের মধ্যে বাকী থাকবে না। বর্ণনাকারী বলেন, আমি তাঁকে সূরাহ আনফাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এ সূরাটি বদর যুদ্ধের সময় অবতীর্ণ হয়েছে। আমি তাকে সূরাহ হাশর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটি বানী নযীর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। [বুখারী পর্ব ৬৫ সূরা (৫৯) আল-হাশর অধ্যায় ১ হাদীস নং ৪৮৮২; মুসলিম ৫৪/৬, হাঃ ৩০৩১]
মাদকদ্রব্যের নিষিদ্ধতা সম্পর্কীয় বিধান অবতরণ।
ইবনু ‘উমার (রাঃ) তিনি বলেনঃ ‘উমার (রাঃ) মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতে গিয়ে বললেন, নিশ্চয় মদ হারাম সম্পর্কীয় আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আর তা তৈরী হয় পাঁচটি বস্তু থেকেঃআঙ্গুর, খেজুর, গম, যব ও মধু। আর খামর (মদ) হল তা, যা বিবেক বিলোপ করে দেয়। আর তিনটি এমন বিষয় আছে যে, আমি চাইছিলাম যেন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কাছে সেগুলো স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা পর্যন্ত তিনি যেন আমাদের নিকট হতে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যান। বিষয়গুলো হল, দাদা এর মীরাস, কালালা-এর ব্যাখ্যা এবং সুদের প্রকারসমূহ। (বুখারী পর্ব ৭৪ অধ্যায় ৫ হাদীস নং ৫৫৮৮; মুসলিম ৫৪০/৬, হাঃ ৩৩২)
আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃএ দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী দল (বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীরা) তাদের প্রভুর ব্যাপারে পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়। (সূরা হাজ্জ ২২/১৯)
কায়স (রহ.) তিনি বলেছেন, আমি আবূ যার (রাঃ)-কে কসম করে বলতে শুনেছি যে, “এরা দু’টি বিবদমান পক্ষ তারা তাদের প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্ক করে” আয়াতটি বাদরের দিন পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হামযাহ, ‘আলী, ‘উবাইদা ইবনুল হারিস, রাবী‘আর দু’ পুত্র উতবাহ ও শায়বাহ এবং ওয়ালীদ ইব্নু উতবাহর সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। (বুখারী পর্ব ৬৪ অধ্যায় ৮ হাদীস নং ৩৯৬৯; মুসলিম ৩০৩৩)