3. সন্তানের প্রতি মমতা
অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি দুইটি বা একটি কন্যা সন্তান পোষে।
উকবা ইবনে আমার (রাঃ) আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ যার তিনটি কন্যাসন্তান আছে এবং সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করে এবং তাদেরকে যথাসাধ্য উত্তম পোশাকাদি দেয়, তারা তার জন্য দোযখ থেকে রক্ষাকারী প্রতিবন্ধক হবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)। ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী (সাঃ) বলেন, যে মুসলমানের দুইটি কন্যা সন্তান আছে এবং সে তাদেরকে উত্তম সাহচর্য দান করে তারা তাকে বেহেশতে দাখিল করবে (ইবনে মাজাহ, হাকিম)। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যার তিনটি কন্যা সন্তান আছে এবং সে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে তাদের ব্যয়ভার বহন করে এবং তাদের সাথে দয়ার্দ্র ব্যবহার করে, তার জন্য বেহেশত অবধারিত হয়ে যায়। লোকজনের মধ্য থেকে একজন বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কারো যদি দুটি কন্যা সন্তান থাকে? তিনি বলেনঃ দুইটি কন্যা সন্তান হলেও (আবু দাউদ, তাবারানী, বাযযার)।
অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি তিন বোনকে লালন-পালন করলো।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন ; যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনটি বোন আছে এবং সে তাদের সাথে মমতাপূর্ণ ব্যবহার করে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে (দারিমী, তিরমিযী, আবু দাউদ, হিব্বান)।
অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি নিজের তালাকপ্রাপ্তা (বা বিধ বাযযার) কন্যার প্রতিপালন করে তার ফযীলাত।
মূসা ইবনে উলায়্যি (র) নবী (সাঃ) সুরাকা ইবনে জুশুম (রাঃ)-কে বলেনঃ আমি কি তোমাকে শ্রেষ্ঠতম বা অতীব শ্রেষ্ঠ দান-খয়রাত সম্পর্কে অবহিত করবো না? তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই। তিনি বলেনঃ তোমার নিকট ফিরে আসা তোমার (স্বামী পরিত্যক্ত) কন্যার ব্যয়ভার বহন করা, তুমি ছাড়া যার জন্য উপার্জনকারী আর কেউ নাই (ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, নাসাঈ)। মিকদাম ইবনে মাদীকারিব (রাঃ) তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ তুমি নিজেকে যা খাওয়াও তা তোমার জন্য সদাকা। তোমার সন্তানকে তুমি যা খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদাকা, তোমার স্ত্রীকে তুমি যা খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা এবং তোমার খাদেমকে যা খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদাকা (আবু দাউদ)।
অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি কন্যা সন্তানদের মৃত্যু কামনা অপছন্দ করে।
ইবনে উমার (রাঃ) এক ব্যক্তি তার সাথে থাকতো। তার কয়েকটি কন্যা সন্তান ছিল। সে তাদের মৃত্যু কামনা করলো। ইবনে উমার (রাঃ) ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, তুমি কি তাদের রিজিক দাও?
অনুচ্ছেদঃ মানুষ সন্তানের কারণে কৃপণ ও কাপুরুষ হয়।
আয়েশা (রাঃ) একদিন আবু বাকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ পৃথিবীর বুকে উমারের চেয়ে অধিক প্রিয় আমার কাছে আর কেউ নাই। তিনি চলে যাবার পর পুনরায় ফিরে এসে বলেন, হে বৎস! আমি কিভাবে শপথ করেছি? আমি তাকে তা বললাম। তিনি বলেন, (উমার) আমার নিকট অধিক প্রিয়। আর সন্তান তো অন্তরের সাথে লেগে থাকে (তারীখ ইবনে আসাকির)। ইবনে আবু নুম (র) আমি ইবনে উমার (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি তাকে মশার রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তিনি বলেন, তুমি কোথাকার লোক? সে বললো, ইরাকের। তিনি বলেন, দেখো তাকে! সে আমাকে মশার রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। অথচ এরা নবী (সাঃ)-এর নাতিকে হত্যা করেছে। আমি নবী (সাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ এরা দুজন পৃথিবীতে আমার দু’টি ফুল (তিরমিযী, আবু দাউদ, হাকিম)।
অনুচ্ছেদঃ শিশুকে কাঁধে উঠানো।
বারাআ (রাঃ) আমি নবী (সাঃ)-কে দেখেছি যে, হাসান তাঁর কাঁধের উপর আসীন অবস্থায় তিনি বলছেনঃ হে আল্লাহ! আমি একে ভালোবাসি। অতএব তুমিও একে ভালোবাস (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ)।
অনুচ্ছেদঃ সন্তান হলো নয়ন প্রীতিকর।
জুবায়ের ইবনে নুফায়ের (র) একদিন আমরা মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)-র নিকট বসলাম। এক ব্যক্তি তাকে অতিক্রম করতে করতে বললো, ধন্য এই চক্ষুদ্বয়, যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দর্শন করেছে। আল্লাহর শপথ! আমরা কামনা করতাম আপনি যা দেখেছেন যদি আমরাও তা দেখতাম এবং আপনি যেখানে উপস্থিত ছিলেন, আমরাও যদি তথায় উপস্থিত থাকতাম। এতে মিকদাদ (রাঃ) অসন্তুষ্ট হলেন। তাতে আমি অবাক হলাম যে, সে তো ভালো কথাই বলেছে। অতঃপর তিনি তার মুখোমুখি হয়ে বলেন, লোকটিকে এমন স্থানে উপস্থিতির আকাঙ্ক্ষা করতে কিসে উদ্বুদ্ধ করলো, যেখান থেকে আল্লাহ তাকে অনুপস্থিত রেখেছেন? কি জানি যদি সে সেখানে উপস্থিত থাকতো তবে সে কি করতো। আল্লাহর শপথ বহু লোক রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখেছে কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে অধঃমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছেন। কারণ তারা তাঁর আহবানে সাড়া দেয়নি এবং তাঁকে বিশ্বাসও করেনি। তোমরা কি মহামহিম আল্লাহর প্রশংসা করবে না যে, তিনি তোমাদের যখন সৃষ্টি করেছেন তখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালক ছাড়া আর কাউকে চেনো না। তোমাদের নবী (সাঃ) যা নিয়ে এসেছেন তাকে তোমরা সত্য বলে মেনে নিয়েছো। আল্লাহর শপথ! নবী (সাঃ) আবির্ভূত হন কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে আর কোন নবী আসেননি। নবী আসার পূর্বেকার সেই জাহিলিয়াতের দিনগুলিতে তারা প্রতিমা পূজার চেয়ে উত্তম কোন ধর্ম আছে বলে মনে করতো না। এই পরিস্থিতিতে তিনি ফুরকানসহ আবির্ভূত হন। তিনি তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করেন, পার্থক্য সূচিত করেন পিতা ও তার পুত্রের মধ্যে। শেষে অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, কোন ব্যক্তি তার পিতা বা পুত্র বা ভাইকে কাফের অবস্থায় দেখতো, অপরদিকে ঈমান আনার জন্য তার অন্তরের তালা আল্লাহ খুলে দিতেন, তখন সে ভাবতো, এই অবস্থায় তার আপনজন মারা গেলে নিশ্চয় সে দোযখে যাবে। এতে কারো চোখ জুড়াতো না। এই প্রসঙ্গে মহামহিম আল্লাহ বলেন, “এবং যারা বলে, আমাদের প্রভু! আমাদের স্ত্রীদের ও আমাদের সন্তানদের দ্বারা আমাদেরকে চোখের শীতলতা দান করো” (২৫ : ৭৪) (আবু দাউদ)।
অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি তার সঙ্গীর ধন ও সন্তান বৃদ্ধির দোয়া করে।
আনাস (রাঃ) একদিন আমি নবী (সাঃ)-এর নিকট গেলাম। আমি, আমার মা ও খালা উম্মু হারাম (রাঃ) ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। তখন নবী (সাঃ) আমাদের নিকট এসে বলেনঃ আমি কি তোমাদের সাথে নামায পড়বো না? তখন কোন নামাযের ওয়াক্ত ছিলো না। লোকজনের মধ্যে একজন বললো, আনাসকে কোথায় দাঁড় করানো হয়েছিলো? রাবী বলেন, ডান দিকে। তিনি আমাদের নিয়ে নামায পড়লেন, অতঃপর আমাদের তথা ঘরের সকলের জন্য দোয়া করলেন দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক কল্যাণের জন্য। আমার মা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার এই ক্ষুদে খাদেম, তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। অতএব তিনি আমার সার্বিক কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। তার দোয়ার শেষ ছিলঃ হে আল্লাহ! “তাকে অধিক ধন ও সন্তান দান করুন এবং তাকে বরকত দান করুন” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)।
অনুচ্ছেদঃ মমতাময়ী মা।
আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) এক মহিলা আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে এলে তিনি তাকে তিনটি খেজুর দেন। সে তার ছেলে দু’টিকে একটি করে খেজুর দেয় এবং নিজের জন্য একটি রেখে দেয়। তারা খেজুর দু’টি খেয়ে তাদের মায়ের দিকে তাকালো এবং অবশিষ্ট খেজুরটি পেতে চাইলো। সে খেজুরটি দুই টুকরা করে প্রত্যেককে অর্ধেক অর্ধেক দিলো। নবী (সাঃ) ঘরে আসলে আয়েশা (রাঃ) তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি বলেনঃ এতে তোমার বিস্মিত হওয়ার কি আছে। সে তার ছেলে দুইটির প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার কারণে আল্লাহ তার প্রতি দয়াপরবশ হয়েছেন (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)।
অনুচ্ছেদঃ শিশুদের চুমা দেয়া
আয়েশা (রাঃ) এক বেদুইন নবী (সাঃ)-এর নিকট এসে বললো, আপনার কি শিশুদের চুমা দেন? আমরা শিশুদের চুমা দেই না। নবী (সাঃ) বলেনঃ আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া তুলে নেন, তবে তোমার জন্য আমার কি করার আছে? (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ) আবু হুরাইরা (র) রসূলুল্লাহ সে আলী (র)-এর পুত্র হাসানকে চুমা দিলেন। তখন আকরা ইবনে হাবিস আত-তামীমী তাঁর নিকট বসা ছিলেন। আকরা বলেন, আমার দশটি সন্তান আছে, কিন্তু আমি তাদের কাউকে চুমা দেইনি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার দিকে তাকালেন, অতঃপর বললেনঃ যে ব্যক্তি দয়া করে না সে দয়া পায় না (বুখারী, মুসলিম)।
অনুচ্ছেদঃ সন্তানের সাথে পিতার সদাচরণ এবং তাকে ভদ্র আচরণ শিখানো।
নুমাইর ইবনে আওস (র) প্রবীণ সাহাবীগণ বলতেন, সততা ও যোগ্যতা আল্লাহর দান এবং শিষ্টাচার পিতৃপুরুষের দান। নোমান ইবনে বশীর (র) তার পিতা তাকে বহন করে বাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট গেলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি নোমানকে এই এই জিনিস দান করেছি। তিনি বলেনঃ তোমার সব সন্তানকে কি দান করেছো? তিনি বলেন, না। তিনি বলেনঃ তাহলে আমি ভিন্ন অন্যকে সাক্ষী রাখো। অতঃপর তিনি বলেনঃ তুমি কি কামনা করো না যে, তোমার সকল সন্তান তোমার সাথে সমানভাবে সদ্ব্যবহার করুক? তিনি বলেন, হাঁ। তিনি বলেনঃ তাহলে এরূপ করো না (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)। ইমাম বুখারী (র) বলেন, মহানবী (সাঃ)-এর বক্তব্যে বশীর (রাঃ)-কে অপর কোন ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখার অনুমতি ব্যক্ত করা হয়নি।
অনুচ্ছেদঃ নিজ সন্তানের সাথে পিতার সদাচার।
ইবনে উমার (রাঃ) আল্লাহ তাদের (সাহাবীদের) নাম রেখেছেন আবরার (সদাচারী)। কেননা তারা তাদের পিতা ও সন্তানদের সাথে সদাচার করেছেন। তোমার উপর তোমার পিতার যেমন অধিকার আছে তদ্রুপ তোমার সন্তানের উপর তোমার অধিকার রয়েছে (তাবারানী)।
অনুচ্ছেদঃ যে দয়া করে নাসাঈ, সে দয়া প্রাপ্ত হয় না।
আবু সাঈদ (রাঃ) নবী (সাঃ) বলেনঃ যে দয়া করে না সে দয়া প্রাপ্ত হয় না। (তিরমিযী)। জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যে লোক মানুষের প্রতি দয়া করে নাসাঈ, আল্লাহ তার প্রতি দয়ার্দ্র হন না (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)। জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে নাসাঈ, আল্লাহ তার প্রতি দয়ার্দ হন না (পূর্বোক্ত বরাত)। আয়েশা (রাঃ) একদল বেদুইন নবী (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হলো। তাদের মধ্যকার এক ব্যক্তি বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনারা কি শিশুদের চুমা দেন? আল্লাহর শপথ! আমরা তাদেরকে চুমা দেই না। নবী (সাঃ) বলেনঃ মহামহিম আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া তুলে নেন, তাহলে আমি আর কি করতে পারি (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)! আবু উসমান (র) উমার (রাঃ) এক ব্যক্তিকে কর্মে নিয়োগ করলেন। সেই কর্মচারী বললো, আমার এতোগুলো সন্তান আছে, আমি তাদের একটিকেও চুমা দেইনি। উমার (রাঃ) মন্তব্য করলেন অথবা বললেন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে সদাচারীদেরকেই দয়া করেন।
অনুচ্ছেদঃ আল্লাহর রহমাত শত ভাগে বিভক্ত।
আবু হুরায়রা (রাঃ) আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ মহামহিম আল্লাহ দয়াকে শত ভাগে বিভক্ত করেছেন। তিনি (এর) নিরানব্বই ভাগ নিজের কাছে রেখেছেন এবং মাত্র এক ভাগ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন। এই এক ভাগের কারণে সৃষ্টিকুলের একে অপরের প্রতি দয়াপরবশ হয়, এমনকি ঘোড়া তার পায়ের খুর এই আশংকায় তার শাবকের উপর থেকে তুলে নেয় যাতে সে ব্যথা না পায় (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, দারিমী)।