54. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওফাত

【1】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের দিন আবু বকর (রাঃ) লোকদের ইমামতি করেন

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে শেষবারের মতো দর্শন করলাম, যখন মৃত্যু রোগে আক্রান্ত অবস্থায় সোমবার ফজরের নামাজের সময়; তখন তিনি পর্দা তুলে উম্মতের সালাতে অবস্থা দেখছিলেন। আমি তাঁর চেহারায় যেন আল-কুরআনের পৃষ্ঠা জ্বলজ্বল করতে দেখেছিলাম। লোকেরা আবু বকর (রাঃ) এর পেছনে সালাত আদায় করছিল। (লোকেরা সরে দাঁড়াতে চাইল) কিন্তু তিনি ইঙ্গিতে সকলকে স্থির থাকার নির্দেশ দিলেন এবং আবু বকর (রাঃ) ইমামতি করলেন। সেদিন শেষ বেলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন।[১]

【2】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের

আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের সময় তিনি আমার সিনায় বা আমার কোলে ঠেস লাগিয়ে ছিলেন। অতঃপর তিনি প্রস্রাব করার জন্য একটি পাত্র আনতে বললেন এবং তাতে প্রস্রাব করলেন। এরপর তিনি ইন্তেকাল করেন।[১]

【3】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন

আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর কষ্ট দেখার পর অন্য কারো মৃত্যুর সময় কষ্ট হলে আমার হিংসা হয় না।

【4】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাঁর মৃত্যুর স্থানেই দাফন করা হয়

আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকাল হলো তখন তাঁর দাফন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিল। আবু বকর (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এ সম্পর্কে এমন কিছু শুনেছি, যা আমি আজও ভুলিনি। অতঃপর বলেন, আল্লাহ তা’আলা নবীদেরকে এমন স্থানেই মৃত্যু দেন, যেখানে দাফন করা তিনি পছন্দ করেন। অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাঁর মৃত্যুশয্যার স্থানেই দাফন করা হোক।[১]

【5】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর আবু বকর (রাঃ) তাঁর কপালে চুম্বন করেন

ইবনে আব্বাস ও আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর আবু বকর (রাঃ) তাঁর কপালে চুম্বন করেন।[১] আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর আবু বকর (রাঃ) তাঁর নিকট এসে তাঁর দুই চোখের মাঝখানে মুখ লাগিয়ে চুম্বন করেন এবং তাঁর বাহুতে দু’হাত রেখে বলেন, হায় নবী! হায় অন্তরঙ্গ বন্ধু! হায় বন্ধু![১]

【6】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুতে সাহাবীদের কাছে সবকিছু অন্ধকার মনে হচ্ছিল

আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন মদিনায় প্রবেশ করছিলেন, সেদিন সেখানকার প্রতিটি জিনিস আলোকোজ্জল হয়ে পড়েছিল। অতঃপর যেদিন তিনি ইন্তেকাল করেন, সেদিন আবার তথাকার প্রতিটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা তাঁর দাফনকার্য শেষ করে কবরের মাটি থেকে হাত ঝাড়া না দেইত আমাদের অন্তরে পরিবর্তন অনুভব করলাম।[১]

【7】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারের দিন ইন্তেকাল করেন

আয়েশা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারের দিন ইন্তেকাল করেন।[১]

【8】

মঙ্গলবারের দিন রাতে তাঁকে দাফন করা হয়

জা’ফর ইবনে মুহাম্মাদ (রহঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারে ইন্তেকাল করেন। সোমবার ও মঙ্গলবার দাফন-কাফনের প্রস্তুতিতেই চলে যায়। অতঃপর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে তাঁকে দাফন করা হয়।

【9】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যু ও আবুবকর (রাঃ) এর বাইয়াত গ্রহণ

সাহাবী সালিম ইবনে উবাইদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সালাতের সময় হয়েছে কি? সাহাবীগণ বলেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমরা বেলালকে আযান দিতে নির্দেশ দাও এবং আবু বকরকে ইমামতি করতে বলো। অতঃপর তিনি আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বলেন, সালাতের সময় হয়েছে কি? সাহাবীগণ বলেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমরা বেলালকে আযান দিতে বলো এবং আবু বকরকে ইমামতি করতে বলো। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার পিতা কোমল হৃদয়ের লোক। যখন আপনার স্থানে দাঁড়াবেন, তখন কেঁদে ফেলবেন এবং ইমামতি করতে সক্ষম হবেন না। আপনি যদি তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নির্দেশ দিতেন। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরে এ তিনি বললেন, তোমরা বেলালকে আযান দিতে বলো এবং আবু বকরকে লোকদের সালাত পড়াতে বলো। পুনরায় আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার পিতা কোমল হৃদয়ের লোক। তিনি ঐ ইমামতের জায়গায় দাঁড়ালে কেদে ফেলবেন এবং ইমামতি করতে সক্ষম হবেন না। আপনি যদি তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নির্দেশ দিতেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তো ইউসুফ (আঃ) এর ঘটনার সাথে জড়িত মহিলাদের মতো। বর্ণনাকারী বলেন, বেলাল (রাঃ)-কে আযান দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলে তিনি আযান দেন এবং আবু বকর (রাঃ)-কে নির্দেশ দেয়া হলে তিনি লোকদের সালাত পড়ান। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা সুস্থতাবোধ করে বলেন, দেখতো! আমার ভর নেয়ার মতো কোন লোক পাওয়া যায় কি না? তখন বর্ণনাকারী ও অপর এক লোক এলে তিনি তাদের উপর ভর করেন (এবং মসজিদে যান)। তাঁকে দেখে আবু বকর (রাঃ) পেছনে সরে আসতে উদ্যোগী হলে তিনি তাকে স্বস্থানে স্থির থাকতে ইশারা করেন। এ অবস্থায় আবু বকর (রাঃ) সালাত আদায় করান। অতঃপর সোমবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করলে উমার (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনব যে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন” আমি আমার তরবারি দিয়ে তাকে আঘাত করব। আর লোকদের এ ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। কারণ, তারা ইতোপূর্বে কোন নবীর মৃত্যু দেখেনি। তাই তারা নীরব থাকেন। কতিপয় সাহাবী বলেন, হে সালেম, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথীকে ডেকে আন। অতএব আমি আবু বকর (রাঃ) এর নিকট এলাম। তখন তিনি মসজিদে ছিলেন। আমি দিশেহারা হয়ে কান্নারত অবস্থায় আবু বকর (রাঃ) এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ইন্তেকাল করেছেন? আমি বললাম উমার (রাঃ) বলেছেন, যাকে এ কথা বলতে শুনবো যে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন” আমি আমার এ তরবারী দ্বারা তাকে আঘাত করব। আবু বকর (রাঃ) আমাকে বললেন, চলো। অতএব আমি তাঁর সাথে চললাম এবং তিনিও আসলেন। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখার জন্য লোকজন এসে সমবেত হয়েছে। তিনি বলেন, হে লোক সকল, আমার জন্য রাস্তা করে দাও। তিনি এসে তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং কপালে চুম্বন করে এ আয়াত পড়েন, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ অর্থাৎ নিশ্চয় আপনি মরণশীল এবং তারাও (আপনার শক্ররা) মরণশীল।[১] অতঃপর লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে রাসূলের সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ইন্তেকাল করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সবাই বিশ্বাস করলেন, তিনি সত্য কথাই বলেছেন। তারা আবার জিজ্ঞেস করেন, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথী! আমরা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জানাযা পড়ব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারা জিজ্ঞেস করেন, তা কী নিয়মে? তিনি বললেন, একদল লোক প্রবেশ করবে, তারা তাকবীর বলবে, দুআ করবে এবং দরূদ পাঠ করবে। তারা বের হয়ে এলে আরেক দল প্রবেশ করে একই নিয়েম তাকবীর, দু’আ ও দরূদ পড়ে বের হয়ে আসবে। এ নিয়মে জামা'আত ছাড়া সকলে আলাদা আলাদা জানাযার সালাত আদায় করবে। তারা আবার জিজ্ঞেস করেন, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গী! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কি দাফন করা হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারা জিজ্ঞেস করেন, কোথায়? তিনি বললেন, যে স্থানে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে সেখানেই। আল্লাহ তাঁর পছন্দের স্থানেই তাঁর জান কবয করেছেন। তখন সকলের বিশ্বাস হলো, তিনি সত্য কথাই বলেছেন। তারপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গোসল দেয়ার জন্য তাঁর পরিবারবর্গ ও আত্মীয়-স্বজনকে আদেশ করেন। অতঃপর মুহাজিররা (খেলাফত প্রশ্নে) পরামর্শের জন্য মিলিত হন। মুহাজিররা আবু বকর (রাঃ)-কে বললেন, আমাদেরকে নিয়ে আনসার ভাইদের কাছে চলুন এবং এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সাথে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করব। আনসারগণ বললেন, আমাদের মধ্য হতে একজন আমীর এবং আপনাদের (মুহাজিরদের) মধ্য থেকে একজন আমীর হোক। তখন উমার (রাঃ) বললেন, এমন কে আছে, যে এই ঘটনার তৃতীয়জন (যে ঘটনাটির ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেন)- ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا “দু’জনের একজন যখন তারা ছিল গুহার মধ্যে, যখন সে তাঁর সাথীকে বলল, বিচলিত হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।[2] কারা ছিলেন সে দু’জন? বর্ণনাকারী বলেন, তারপর উমার (রাঃ) তাঁর হাত প্রসারিত করে দিয়ে আবু বকর (রাঃ)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তারপর লোকেরাও তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।[3]

【10】

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুতে ফাতিমা (রাঃ) এর ক্ৰন্দন

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত্যুর কষ্ট ভোগ করছিলেন, তখন ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হায়! আমার আব্বার কতই না কষ্ট হচ্ছে! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আজকের পর তোমার পিতার আর কোন কষ্ট থাকবে না। তোমার পিতার নিকট মৃত্যু নামক এমন এক বিষয় উপস্থিত হয়েছে, যা থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কেউ রেহাই পাবে না।[১]