2. অবিচ্ছেদ্য সাক্ষী হতে সাবধান
অবিচ্ছেদ্য সাক্ষী হতে সাবধান
ইবনু ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘(ক্বিয়ামতের দিন) আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে নিজের নিকটবর্তী করবেন এবং আল্লাহ্ তা’আলা নিজ বাজু তার উপরে রেখে তাকে ঢেকে নিবেন। অতঃপর আল্লাহ্ সেই বান্দাকে বলবেন, আচ্ছা! বল দেখি, এই গোনাহটি তুমি করেছ কি? এই গোনাহটি সম্পর্কে তুমি অবগত আছ কি? সে বলবে হ্যাঁ, হে আমার রব! আমি অবগত আছি। শেষ পর্যন্ত এক একটি করে তার কৃত সমস্ত গোনাহের স্বীকৃতি আদায় করবেন। এদিকে সে বান্দা মনে মনে এই ধারণা করবে যে, সে এই সমস্ত অপরাধের কারণে নির্ঘাত ধ্বংস হবে। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, দুনিয়াতে আমি তোমার এই সমস্ত অপরাধ ঢেকে রেখেছিলাম। আর আজ আমি তা মাফ করে দিবো। অতঃপর তাকে নেকীর আমলনামা দেওয়া হবে। আর কাফের ও মুনাফিকদেরকে সমস্ত সৃষ্টির সম্মুখে আনয়ন করা হবে এবং উচ্চস্বরে এই ঘোষণা দেওয়া হবে- এরা তারা, যারা স্বীয় পরওয়ারদিগারের বিরুদ্ধে মিথ্যারোপ করত। জেনে রাখ, এই সমস্ত যালিমদের উপর আজ আল্লাহর লা’নত’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৫৫১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩১৭)। আনাস (রাঃ) আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে ছিলাম, হঠাৎ তিনি হাসলেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান আমি কেন হাসছি? আমরা বললাম, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, ক্বিয়ামতের দিন বান্দা যে তার রবের সাথে সরাসরি কথা বলবে, সেই কথাটি স্মরণ করে হাসছি। বান্দা বলবে, হে রব! তুমি কি আমাকে যুলম হতে নিরাপত্তা দান করনি? আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ, তখন বান্দা বলবে, আজ আমি আমার সম্পর্কে আপনজন ব্যতীত আমার বিরুদ্ধে অন্য কারও সাক্ষ্য গ্রহণ করব না। তখন আল্লাহ বলবেন, আজ তুমি নিজেই তোমার সাক্ষী হিসাবে এবং কিরামান-কাতেবীনের সাক্ষ্যই তোমার জন্য যথেষ্ট। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তার মুখের উপর মোহর লাগিয়ে দিবেন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলা হবে, তোমরা কে কখন কি কি কাজ করেছো বল। তখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ তাদের কৃতকর্মসমূহ প্রকাশ করে দিবে। এরপর তার মুখকে স্বাভাবিক অবস্থায় খুলে দেওয়া হবে। তখন সে স্বীয় অঙ্গসমূহকে লক্ষ্য করে আক্ষেপের সাথে বলবে, হে দুর্ভাগা অঙ্গসমূহ! তোরা দূর হ! তোদের ধ্বংস হৌক! তোদের জন্যই তো আমি আমার রবের সাথে ঝগড়া করেছিলাম’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৫৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩২০)। আবু হুরায়রা (রাঃ) ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! ক্বিয়ামতের দিন কি আমরা আমাদের রবকে দেখতে পাব? তিনি বললেন, দ্বিপ্রহরে মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য দেখতে কি তোমাদের মধ্যে পরস্পরে বাধা সৃষ্টি হয়? তারা বললেন, না। তিনি আরও বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার রাত্রে পূর্ণ চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কোন প্রকারের অসুবিধা হয়? তারা বললেন, না। অতঃপর তিনি বললেন, সেই মহান সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! এই দু’টির কোন একটিকে দেখতে তোমাদের যেই পরিমাণ অসুবিধা হয়, সেই দিন তোমাদের রবকে দেখতে সেই পরিমাণ অসুবিধাও হবে না। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তখন আল্লাহ তা’আলা কোন এক বান্দাকে লক্ষ্য করে বলবেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে মর্যাদা দান করিনি? আমি কি তোমাকে সর্দারী দান করিনি? আমি কি তোমাকে বিবি দান করিনি? আমি কি তোমার জন্য ঘোড়া ও উটকে অনুগত করে দেয়নি? আমি কি তোমাকে এই সুযোগ দেয়নি যে, তুমি নিজ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিবে এবং তাদের নিকট হতে এক-চতুর্থাংশ মাল ভোগ করবে? জবাবে বান্দা বলবে, হ্যাঁ, (হে আমার প্রতিপালক!)। অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা বান্দাকে বললেন, আচ্ছা বল দেখি, তোমার কি এই ধারণা ছিল যে, তুমি আমার সাক্ষাৎ লাভ করবে? বান্দা বলবে, না। এইবার আল্লাহ বলবেন, (দুনিয়াতে) তুমি যেভাবে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে আজ আমিও (আখেরাতে) অনুরূপভাবে তোমাকে ভুলে থাকব। (অর্থাৎ তোমাকে আযাবে লিপ্ত রাখব)। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা দ্বিতীয় এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবেন, সেও অনুরূপ বলবে। তারপর তৃতীয় এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং তাকেও অনুরূপ কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার প্রতি, তোমার কিতাবের প্রতি এবং তোমার সমস্ত নবীগণের প্রতি ঈমান এনেছি, ছালাত আদায় করেছি, ছিয়াম পালন করেছি এবং দান-ছাদাক্বা করেছি। মোটকথা, সে সাধ্য পরিমাণ নিজের নেক কার্যসমূহের একটি তালিকা আল্লাহর সম্মুখে তুলে ধরব। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আচ্ছা! তুমি তো তোমার কথা বললে, এখন এখানেই দাঁড়াও, এক্ষুণি তোমার ব্যাপারে সাক্ষী উপস্থিত করছি। এই কথা শুনে বান্দা মনে মনে চিন্তা করবে, এমন কে আছে যে, এখানে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে? অতঃপর তার মুখে মোহর লাগিয়ে দেওয়া হবে এবং তার রানকে বলা হবে, তুমি বল, তখন তার রান, হাড়, মাংস প্রভৃতি এক একটি করে বলে ফেলবে, এরা যা যা করেছিল। তার মুখে মোহর লাগিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হতে এই জন্য সাক্ষী গ্রহণ করা হবে, যেন সেই বান্দা কোন ওযর-আপত্তি পেশ করতে না পারে। বস্তুতঃ যেই বান্দার কথা আলোচনা করা হয়েছে, সে হ’ল মুনাফিক এবং এই কারণেই আল্লাহ তার প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হবেন’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৫৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩২১)। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন এমন এক ব্যক্তিকে জনসম্মুখে উপস্থিত করা হবে, যার আমলনামা খোলা হবে নিরানব্বই ভলিয়মে এবং প্রতি ভলিয়ম বিস্তীর্ণ হবে দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আচ্ছা বল দেখি, তুমি এর কোন একটিকে অস্বীকার করতে পারবে? অথবা আমার লিখক ফেরেশতাগণ কি তোমার প্রতি যুলুম করেছে? সে বলবে, না। হে আমার রব্ব! আল্লাহ তা’আলা জিজ্ঞেস করবেন, তবে কি তোমার পক্ষ হতে কোন ওযর পেশ করার আছে? সে বলবে, না; হে আমার রব! তখন আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ, তোমার একটি নেকী আমার নিকট রক্ষিত আছে। তুমি নিশ্চিত জেনে রাখ, আজ তোমার প্রতি কোন যুলুম বা অবিচার করা হবে না। এরপর এক টুকরা কাগজ বের করা হবে, যাতে লিখা আছে, أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ [অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ, (মা‘বূদ) নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসূল]। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, তোমার আমলের ওযন দেখার জন্য উপস্থিত হও। তখন সে বলবে, হে আমার রব! ঐ সমস্ত বিরাট বিরাট দফতরের মুকাবিলায় এই এক টুকরা কাগজের মূল্যই বা কি আছে? তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার উপর কোন অবিচার করা হবে না। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, অতঃপর ঐ সমস্ত দফতরগুলি এক পাল্লায় এবং এই কাগজের টুকরাখানি আরেক পাল্লায় থাকবে। কাগজের টুকরা যে পাল্লায় থাকবে তা ভারী হয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে থাকবে। মোটকথা, আল্লাহর নামের সাথে অন্য কোন জিনিস ওযনই হতে পারবে না’ (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৫৫৯; বাংলা মিশকাত হা/৫৩২৪)। আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সাথে তার রব কথাবার্তা বলবেন না। তার ও তার রবের মধ্যে কোন দোভাষী এবং এমন কোন পর্দা থাকবে না, যা তাকে আড়াল করে রাখবে। সে তার ডানে তাকাবে, তখনও পূর্বে প্রেরিত আমল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। আবার বামে তাকাবে, তখনও পূর্ব প্রেরিত আমল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। আর সম্মুখের দিকে তাকালে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। যা একেবারে চেহারার সম্মুখে অবস্থিত। সুতরাং খেজুর ছালের বিনিময়ে হলেও জাহান্নাম হতে বাঁচতে চেষ্টা কর’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৫৫০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩১৬)। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, সেই মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! সেই সময় পর্যন্ত ক্বিয়ামত কায়েম হবে না যে পর্যন্ত না হিংস্র পশু মানুষের সাথে কথা বলবে এবং যে পর্যন্ত না কারও চাবুক তার সাথে কথা বলবে, তার জুতার ফিতা তার সাথে কথা বলবে। আর তার উরু তাকে জানিয়ে দিবে যে, তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী কি করেছে’ (তিরমিযী, বাংলা মিশকাত হা/৫২২৫)। বাহয ইবনু হাকিম তার পিতা বাহয ইবনু হাকিম তার পিতার মধ্যস্থতায় বর্ণনা করেন, তার দাদা বলেন, নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদেরকে মুখ বন্ধ করে ডাকা হবে। সেদিন তোমাদের মুখ বন্ধ থাকবে। সর্বপ্রথম তোমাদের উরু এবং কাধকে জিজ্ঞেস করা হবে’ (নাসাঈ, ইবনু কাছীর হা/৫৬৬৯)। উকবা ইবনু আমের (রাঃ) তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষের যখন মুখ বন্ধ থাকবে, তখন তার বাম উরুর হাড় সর্বপ্রথম কথা বলবে’ (ইবনু কাছীর ৫৬৭১)।